উনি আমার দিকে তাকিয়ে শুধু একটু হাসেন।
আমি খুব জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, যাক, বাঁচালেন।
জয়ন্তী একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলেন, তার মানে?
–আপনার হাসি দেখে বুঝলাম, আপনি রাগ করেন নি।
-কেন? রাগ করব কেন?
হঠাৎ একটু চপলতা প্রকাশ করেই মনে হয়েছিল, বোধহয় আপনি অসন্তুষ্ট হবেন।
জয়ন্তী বেশ গম্ভীর হয়েই বললেন, এ সংসারে বেঁচে থাকার ঝামেলা তো কম নয় কিন্তু একটু-আধটু হাসি-ঠাট্টা বা চপলতা না হলে কী আমরা কেউ বাঁচতে পারব?
উনি একটু থেমে আবার বলেন, আমি নিজেও বেশী গম্ভীর থাকতে পারি না; আবার বেশী গম্ভীর লোককে বেশীক্ষণ সহ্যও করতে পারি না।
-আমিও তাই।
–সে আপনাকে দেখেই বুঝেছি।
এবার খুব উৎসাহের সঙ্গে প্রশ্ন করি, আমাকে দেখে আর কী বুঝেছেন?
জয়ন্তী চাপা হাসি হেসে বললেন, এখনই সব কথা বলব কেন?
ওর কথায় আমি হেসে উঠি।
একটু পরেই নিত্য ঘুরে এসে জয়ন্তীকে বলল, আপনি যশোর স্টেশনের এ-এস-এম-এর কাছে গেলেই টিকিট পেয়ে যাবেন। তাছাড়া উনি আপনাকে ট্রেনে চড়িয়ে দেবারও ব্যবস্থা করবেন।
আমি চাপা হাসি হেসে বললাম, ভাগ্যবানের বোঝা ভগবানে বয়!
ওরা দুজনেই হাসে।
এবার নিত্য ওকে বলে, আমরা চেকপোস্টের সবাই সামনের একটা ব্যারাকে থাকি। ওখানে তো আপনাকে নিতে পারি না। দরজার পাশে দাঁড়ান কাস্টমস-এর একজন মহিলা কর্মীকে দেখিয়ে বলল, আপনি এই দিদির সঙ্গে কাস্টমস-এর গেস্ট হাউসে চলে যান। ওখানে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে বিশ্রাম করুন। আমরা দুজনে খানিকটা পরেই আসছি।
জয়ন্তী বললেন, আমার জন্য আপনাদের সবার এত কষ্ট…।
–কিছু কষ্ট না। নিত্য একটু হেসে বলল, সবাই তো মনে মনে আমাদের গালাগালি দেয়। কজন লোক আর আমাদের আপন মনে করে? মন খুলে কথা বলার মত লোক পেলে আমাদের ভালই লাগে।
জয়ন্তী আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন।
নিত্য ওর সহকর্মীদের বলে আমাকে নিয়ে ওদের ব্যারাকে গেল। বলল, চলো বাচ্চু, একটু গল্পগুজব করা যাক।
চেকপোস্টের ঠিক উল্টোদিকেই একটা লম্বা চালাঘর। মাঝে মাঝে পার্টিশন করা। আমি অবাক হয়ে বললাম, এত বছর ধরে তোমাদের চেকপোস্ট হয়েছে কিন্তু তোমাদের কোয়ার্টার তৈরী হয় নি?
–না, ভাই।
–এখানে দিনের পর দিন থাক কী করে? তাছাড়া তোমাদের কেউই তো ফামিলি আনতে পারে না।
নিত্য একটু ম্লান হেসে বলল, আমাদের এসব দুঃখের কথা কে বোঝে আর কে শোনে? তাছাড়া পুলিসের লোকজনেরও যে দুঃখ কষ্ট আছে, তা কজন বিশ্বাস করে?
পাশাপাশি দুটো তক্তপোশের উপর বালিশে হেলান দিয়ে আমরা মুখোমুখি বসে কথা বলি। ও পকেট থেকে একটা লাল সিগারেটের প্যাকেট বের করতেই আমি জিজ্ঞেস করি, এ আবার কী সিগারেট। এ রকম প্যাকেট তো দেখিনি।
নিত্য পকেটটা আমার হাতে দিয়ে বলল, এ তো আমাদের দেশের সিগারেট না, ওপারের।
হ্যাঁ, তাই দেখছি।
–খেয়ে দেখ, বেশ ভাল সিগারেট।
গোল্ড লিফ সিগারেটে টান দিয়ে বলি, হ্যাঁ, বেশ ভাল সিগারেট।
নিত্যও একটা সিগারেট ধরিয়ে একটা টান দিয়ে বলে, বললাম না!
-বনগাঁয় কী এই সিগারেট পাওয়া যায়?
ও একটু আত্ম প্রসাদের হাসি হেসে বলল, না পাওয়া গেলেও আমরা পেয়ে যাই। মুহূর্তের জন্য একটু থেমে বলল, লোকজন দিয়ে যায় বলেই খাই। নিজের পয়সায় কী এইসব সিগারেট খাওয়া যায়?
আমি হেসে বলি, তাহলে ভালই আছ, কী বল?
-ভাল আছি, তাও বলতে পারি না; আবার ভাল নেই, তাও বলা ঠিক হবে না।
তার মানে?
নিত্য সিগারেটে একটা টান দিয়ে তুড়ি দিয়ে ছাই ফেলে বলল, জানোই তো পুলিসের চাকরিতে সব সময় টু পাইস এক্সট্রা ইনকাম থাকে। আই-বির মত দু একটা জায়গা ছাড়া এমন কোন জায়গা নেই, যেখানে আমাদের এক্সট্রা ইনকাম নেই।
ওর কথায় আমি হাসি।
–হাসছ কী ভাই? আজকাল কলকাতা পুলিসের এমন কনস্টেবলও আছে, যারা মাসে মাসে দশ হাজার টাকার বেশী আয় করে।
-বলো কী?
-তুমি তো দিল্লী চলে গেছ, তাই কলকাতার খবর রাখো না। যে পুলিশকে চোর-ডাকাত গুণ্ডা-বদমাইশরা ভয় করত, সে পুলিস আর নেই। এখন আমরাই ওদের ভয় করি।
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করি, কেন?
একটু ম্লান হাসি হেসে নিত্য বলল, আজকাল পলিটিসিয়ানদের হাতে গুণ্ডারা, নাকি গুন্ডাদের হাতে পলিটিসিয়ানরা, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।
–কিন্তু …
ও মাথা নেড়ে বলল, কোন কিছু নেই ভাই। আজকাল আমরা নেংটি ইঁদুর ধরলেও হয় বাঘ, না হয় সিংহ গর্জন করে উঠবেই।
আমি প্রসঙ্গ বদলে জিজ্ঞেস করি, যাই হোক, তুমি এখানে কেমন আছো, তাই বলো।
–পোস্টিং হিসেবে ভালই তবে…।
–ভালই মানে?
নিত্য একটুও দ্বিধা না করে বলল, ভালই মানে না চাইলেও বেশ টু পাইস ইনকাম আছে এখানে। আর তাছাড়া খুব ইন্টারেস্টিং।
–ইন্টারেস্টিং মানে?
–ইন্টারেস্টিং মানে বহু বিখ্যাত মানুষ থেকে শুরু করে নানা ধরনের নানা মানুষ দেখা যায়। ও একটু থেমে বলল, থানায় মোটামুটি একই ধরনের ঘটনা বা মানুষ দেখা যায় কিন্তু এখানে নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা হয়।
আমি চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। নিত্য বলে যায়, এই চেকপোস্টে বসে বসে কত মানুষের কত কাহিনী যে জানলাম, কত রকমের কত ঘটনা যে চোখের সামনে দেখলাম, তা তুমি ভাবতে পারবে না।
-তাই নাকি?
-হ্যাঁ, ভাই। একটু শুকনো হাসি হেসে বলল, ফেরার পথে এখানে দু একদিন থাকলে তোমাকে সব বলব।