পাশ্চাত্য দেশে ও দেশবাসীর কাছে এসব ব্যাপার ডাল-ভাত। সকালে প্যারিসে ব্রেকফার্স্ট খেয়ে মিলানে ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজ সেরে ভিয়েনায় লাঞ্চের পর কনফারেন্সে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে বার্লিনে বান্ধবীর উষ্ণ সান্নিধ্যে নাচ-গান-ডিনার শেষ করে ঘরের ছেলে ঘরে ফের। আজ লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রেয়সীর শুধু একটা চুম্বনের জন্য বস্টনের ছেলে-ছোকরাদের গাড়ি নিয়ে কানাডার কোন সীমান্ত শহরে ছুটে যাওয়া বা নায়েগ্রার ধারে ঘূর্ণায়মান কাফেতে কিছুক্ষণ কাটিয়ে এলে বাড়ির কেউ জানতেও পারেন না।
সমস্যা সমাজতান্ত্রিক ও এশিয়া-আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলিতে। কোথাও রাজনৈতিক কারণে, কোথাও অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য মানুষের ঘোরাঘুরির পথে বহু বাধা, বহু বিঘ্ন।
অতীত দিনের ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ নিয়মিত সমুদ্র পাড়ি দিয়েছেন, হিমালয়ও অতিক্রম করেছেন। তাদের অনেকের অনেক কথাই ইতিহাসের পাতায় পাতায় আজো ছড়িয়ে থাকে। তারপর কত কী অঘটন ঘটে গেল। এই বিরাট উপমহাদেশের সমস্ত মানুষগুলো যেন বাতগ্রস্ত হয়ে ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে রইল। কাশী গয়। যাত্রাকেই অন্তিম যাত্রা মনে করতেন আত্মীয়-স্বজনের দল। ওপার থেকে সাহেব-মেমের এলেন, আমরা ইংরেজি বুলি শিখলাম কিন্তু যে দেশের অতি সাধারণ সওদাগরের দল নির্বিবাদে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে পৃথিবীর নানা দিগন্তে মসলিন ও তাঁতের শাড়ি বিক্রি করতেন, সে দেশেরই আলালের ঘরের দুএকটি দুলাল কালাপানি পাড়ি দিলে হৈচৈ পড়ে যেত। গঙ্গা দিয়ে অনেক অনেক জল গড়িয়ে গেছে কিন্তু আজো মানুষের শেয়ার বাজারে বিলেতফেরতের দাম বেশ চড়া।
সে যাই হোক ঝগড়া-বিবাদ সংঘাত-সংঘর্ষ ও সর্বোপরি অসংখ্য মানুষের অনেক রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে এই উপমহাদেশ টুকরো টুকরো হবার পর ভারতবাসীরা লণ্ডন নিউ ইয়র্ক-প্যারিস যেতে ভয় না পেলেও পাকিস্তান যেতে দ্বিধা করেছে। বিদ্বেষ ও হিংসার মধ্যে দিয়ে যে দুটি দেশের জন্ম, সেদেশের মানুষের মনে এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংশয় থাকবেই। বিস্ময় ও মজার কথা পাকিস্তানের বুক চিরে নতুন বাংলাদেশের জন্ম হবার পরও এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কালো মেঘ পুরোপুরি কাটে নি।
উড়োজাহাজের বড়লোক খদ্দেরদেরও বিমান বন্দরে পাসপোর্ট ভিসা পরীক্ষা ও মালপত্র তল্লাসী হয় কিন্তু সেখানে তেমন ভীতি বা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে না। হতভাগ্যের দল যাতায়াত করেন হরিদাসপুর বেনাপোলের মত সীমান্ত অতিক্রম করে। এই সীমানা পার হওয়া নিয়ে সংশয় নেই, এমন মানুষ সত্যি দুর্লভ।
অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়দের বিদায় জানিয়ে নিত্যর অফিসে ফেরার পথে জয়ন্তী একটু চাপা গলায় আমাকে বললেন, এই বর্ডারের ভয়ে আমি বিশেষ রংপুর যাই না।
-কিসের ভয়?
-ঝামেলার ভয়, নাস্তানাবুদ হবার ভয়।
আমি কোন মন্তব্য করি না। ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করি, আপনি একেবারেই রংপুর যান না?
-প্রায় চোদ্দ-পনের বছর আগে একবার আমরা সবাই মিলে গিয়েছিলাম। একটু থেমে বলেন, তাও হঠাৎ বাবা অসুস্থ হয়েছিলেন বলেই গিয়েছিলাম।
আমি একটু হেসে, একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, এই এত বছরের মধ্যে আর যান নি?
না।
হঠাৎ যেন দুষ্টু সরস্বতী আমার জিহ্বায় বসায় আমি ওকে বলি, এবার কী আমার সঙ্গে দেখা হবে বলেই…
পুরো কথাটা শেষ করার আগেই জয়ন্তী আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, জানি না; আমি কী জ্যোতিষী?
নিত্য নিজের আসন অলংকৃত করেই আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে ফতোয়া জারী করল, দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর দুজনকে ছাড়া হবে।
আমরা দুজনেই সঙ্গে সঙ্গে আপীল করি। জয়ন্তী বললেন, আপনি আপনার বন্ধুকে রেখে দিন কিন্তু আমাকে আর আটকাবেন না! আমাকে আবার টিকিট-ফিকিটের ব্যবস্থা করে ট্রেন ধরতে হবে।
নিত্য নির্বিকারভাবে হাসতে হাসতে বলল, আপনার গাড়ি তো মাঝ রাত্তিরে। এখন গিয়ে কী করবেন?
–টিকিট রিজার্ভেশনের চেষ্টা করতে হবে না?
–সেসব হয়ে যাবে; কিছু চিন্তা করবেন না।
আমি বললাম, না ভাই নিত্য, যশোরে আমার কাজ আছে। তাছাড়া আজই ঢাকায় পৌঁছতে পারলে ভাল হয়।
ওর মুখে এবারও সেই নির্বিকার হাসি। বলল, এত বছর পর তোমার সঙ্গে দেখা। এক কাপ চা খেয়ে চলে যেতে চাইলেই কী আমি যেতে দিতে পারি?
আমরা দুজনেই অনেক অনুরোধ-উপরোধ, আবেদন-নিবেদন করলাম কিন্তু হরিদাসপুর ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের ভাগ্যবিধাতা তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন না। আমাদের চায়ের ব্যবস্থা করে নিত্য একট বেরুল। বেরুবার সময় শুধু বলল, আমি এখুনি আসছি।
ও ঘর থেকে বেরুতেই জয়ন্তী বললেন, আপনার বন্ধু এমন করে বললেন যে বেশী কিছু বলতে পারলাম না কিন্তু…
আমি ওকে বাধা দিয়ে বললাম, আপনার আর কী? ও তো আপনার টিকিটের ব্যবস্থা করেই দেবে কিন্তু মুশকিলে পড়লাম আমি।
–আপনার মত সাংবাদিকের আবার মুশকিল কী?
না, না, আমার আবার মুশকিল কী? যত মুশকিল আপনার!
–একশ বার। আমি মেয়ে, আপনি ছেলে। তাছাড়া আমি একলা একলা যাচ্ছি।
আমি এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে একটু সতর্ক হয়ে চাপা গলায় বলি, কে আপনাকে একলা যেতে বলেছে?
এ সংসারে চপলতা শুধু কিশোর-কিশোরীর জীবনেই ঘটে না; জীবনের বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে আমরা সবাই চপলতা প্রকাশ না করে পারি না। ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, চপলতা ঘটে যায়। আমি ভাবি নি, এমন চপলতা প্রকাশ করব কিন্তু যা ভাবা যায় না, তা তো ঘটে। নিত্যই ঘটে আমাদের প্রতিদিনের জীবনে। মুহূর্তের জন্য মনে হলো, বোধহয় অন্যায় করলাম।