মেসোমশাই একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, এখন আপনাদের দেখে মনে হচ্ছে, মাঝে মাঝে আসা-যাওয়া করতে পারি।
বেনাপোলের ওসি বললেন, একশ বার আসবেন। আপনাদের আসা-যাওয়ার জন্যই তো আমরা আছি। এবার উনি মাসীমার দিকে তাকিয়ে বললেন, যখন ইচ্ছে নাতি-নাতনীর কাছে যাবেন। কোন অসুবিধা হবে না।
–হ্যা বাবা, সত্যি আবার আসব।
গাড়িতে ওঠার আগে মাসীমা জয়ন্তীকে বুকের মধ্যে মধ্যে জড়িয়ে ধরে বললেন, সাবধানে যেও। আর এই মাসীমাকে ভুলে যেও না। আমরা কলকাতা ফিরে এলে মাঝে মাঝে চলে এসো। খুব খুশি হবো।
–আসব মাসীমা।
মাসীমা আমার মাথায় মুখে দশ বার হাত বুলাতে বুলাতে বলেন, তোমাকে আর কী বলল বাবা! তুমি না থাকলে আমার এইসব ছেলেদের সঙ্গে আলাপই হতো না। তুমিও মাঝে মাঝে দেখা করো।
বললাম, হ্যাঁ মাসীমা, নিশ্চয়ই দেখা করব।
নিত্য বলল, মামীমা, আমিও আসব।
–একশ বার আসবেন। ছেলেমেয়েরা যদি মা-মাসীকে বিরক্ত না করে তাহলে কী মা-মাসী শান্তিতে থাকতে পারে?
অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়ও সবাইকে বার বার ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গাড়িতে উঠলেন।
ওদের গাড়ি রওনা হবার পর এপারের দিকে দুএক পা গিয়েই জয়ন্তী আমাকে বললেন, মাত্র এই কঘন্টার পরিচয় কিন্তু তবু ওরা চলে যাওয়ায় মনটা খারাপ হয়ে গেল।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললাম, মানুষের মন নিয়ে এই ত বিপদ। সে যে মুহূর্তের মধ্যে কখন কাকে ভালবাসবে, তা কেউ বলতে পারে না।
জয়ন্তী একবার আমার দিকে তাকালেন। বোধহয় একটু হাসলেনও।
নিত্য বোধহয় একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল, এখানে যে কত মানুষের কত কি দেখলাম আর জানলাম, তা ভেবেও অবাক হয়ে যাই।
৩-৪. নিত্য কোন কালেই
নিত্য কোন কালেই আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল না, ছিল সহপাঠী। কলেজে আমার অসংখ্য বন্ধু ছিল। অধ্যাপকদের সঙ্গেও আমার হৃদ্যতা ছিল। পড়াশুনা ছাড়াও আরো বহু বিষয় নিয়ে আমি ব্যস্ত থাকতাম। আর নিত্য? সে হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রামে তিন পয়সার টিকিট কেটে কলেজে আসত, ক্লাস করত, আবার তিন পয়সায় হাওড়া পৌঁছে পাঁশকুড়া লোক্যালে চড়ে বাড়ি ফিরে যেত। এই ছিল ওর নিত্যকর্ম পদ্ধতি।
কলেজের পাশেই ছিল ছবিঘর আর পূরবী। আমরা মাঝে মাঝে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এর-ওর কাছ থেকে পয়সাকড়ি ধার করেও সিনেমা বা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলমহমেডানের খেলা দেখেছি কিন্তু নিতা নৈব নৈব চ।
শুধু কী তাই? নিত্য কোনদিন আমাদের সঙ্গে বসে কেষ্ট কাফেতে এক কাপ চা পর্যন্ত খায় নি। তবু সেই নিত্যকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের হরিদাসপুর চেকপোস্টে ও-সি দেখে কত ভাল লাগল। আমাকে পেয়ে ও নিজেও কত খুশি হলো।
এ সংসারে জীবনের সব ক্ষেত্রেই এমন হয়। বিয়ের আগে মেয়েরা যে ভাইয়ের সঙ্গে নিত্য ঝগড়া করেছে, বিয়ের পর দীর্ঘদিনের ব্যবধানে সেই ভাইকে কাছে পেয়েই মেয়েরা যেন হাতে স্বর্গ পায়। আসল কথা, পুরানো দিনের ছিটেফোঁটা স্মৃতিও বর্তমানের অনেক মধুর অভিজ্ঞতার চাইতেও মানুষের কাছে অনেক প্রিয়, অনেক আনন্দের।
উত্তরপ্রদেশের মানুষ ঠিকই বলে, দূরকা ঢোল সাহানাই বরাবর। সত্যি, দূরের ঢোল সানাইয়ের মতই মধুর।
জীবজগতের কোন কিছুই চিরকালের জন্য এক জায়গায় থাকতে পারে না। জীবন-পথের বিবর্তনের মাঝেও সে পরিবর্তন চায় পারিপার্শ্বিকের। কীট পতঙ্গ পশু-পক্ষী থেকে শুরু করে মানুষ পর্যন্ত চিরকাল ধরে ভ্রমণবিলাসী। আজও সেই সুদূর সাইবেরিয়ার নিজের ঘর ছেড়ে হাজার হাজার পাখি কিসের মোহে, কার আকর্ষণে যে আলিপুরের চিড়িয়াখানায় উড়ে আসে, তা শুধু ওরাই জানে।
অতীতে শুধু মার্কোপোলো, আলেকজাণ্ডার, হিউয়েন সাঙ, ইলতুতমিস বা ভাস্কো দ্য গামাই ঘর ছেড়ে বেরোন নি, আরো অনেকেই বেরিয়েছেন। মার্কোপোলের সব সঙ্গই কী স্বদেশে ফিরেছিলেন? আলেকজাণ্ডারের বিরাট সৈন্যবাহিনীর অনেকেই দেশে ফিরে যান নি। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, তারা নতুন দেশে নতুন সংসার পেতেছেন। শুধু ওরাই না, পৃথিবীর বহু দেশের অসংখ্য সওদাগরই সমুদ্রপথে বেরিয়ে তার ফিরে আসেন নি। যারা ফিরে এসেছেন, তাদের অনেকেই আবার বেরিয়েছেন জীবনের টানে বা জীবিকার প্রয়োজনে।
মানুষের এই পথ চলা কোনদিন থামেনি, থামবে না। কাজে অকাজে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সুখে-দুঃখে মানুষকে ঘর ছেড়ে বেরুতেই হয়। হবেই। মানুষ নিজের ঘর, নিজের সংসারকে যত সুন্দর করছে, তার ঘর ছেড়ে পৃথিবী বিচরণও ততই বাড়ছে। যুদ্ধ-বিগ্রহ, সংঘাত সংঘর্ষ, পর্বতপ্রমাণ বিধিনিষেধ দিয়েও কেউ কোনদিন মানুষের পথ চলা বন্ধ করতে পারে নি। পারবে না।
মা ধরিত্রীই তো সৃষ্টির আদিমতম যাযাবর। সে তো কখনই স্থির হয়ে থাকতে পারে না। এই যাযাবর মার সন্তান হয়ে আমরা কী ঘরের কোণেও দুপাঁচজন আত্মীয়-বন্ধুর মোহে বন্দী থাকতে পারি?
যুগের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের যাযাবর বৃত্তি বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে আরো আরো বেশী মানুষ ঘর ছেড়ে বেরচ্ছেন। কোন অশরীরী আত্মা যেন অহর্নিশ মানুষের কানে কানে বলছেন, চরৈবেতি, চরৈবেতি! চলো, চলো, আরো চলো, আবার চলো।
পৃথিবীর কোন মহাশক্তিই মানুষের পায়ে শিকল পরাতে না পারলেও দেশ থেকে দেশান্তরে মানুষের চলা নিয়ন্ত্রিত করার জন্য আছে পাসপোর্ট, আছে ভিসা। প্রতি দেশের সীমানা অতিক্রমের সময় তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়। পাসপোর্টের অঙ্গে মোহরের ছাপ মেরে সযত্নে সতর্কে তার আগমন-নির্গমনের হিসাব রক্ষা করা হয়। শুধু তাই না। বাক্স-পেঁটরা পোঁটলা পুঁটলি তল্লাসী করে দেখা হয়, বাছাধন কি নিয়ে এলেন, কি নিয়ে গেলেন।