যাই হোক, আমরা চা-জলখাবার খেতে খেতেই আমাদের পাসপোর্টগুলোয় ছাপ দিয়ে দিলেন ছোট দারোগাবাবু। আমরা বসে বসে টুকটাক কথাবার্তা বলছিলাম। এমন সময় বাংলাদেশ পুলিসের একজন সিপাই এসে নিত্যকে সেলাম করে একটা ছোট কাগজ দিয়ে বলল, ও সি সাহেব এটা পাঠিয়ে দিলেন।
কাগজের উপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিয়েই নিত্য একটু গলা চড়িয়ে এ-এস-আইকে বললেন, জগন্নাথবাবু, প্রশান্ত মুখার্জী নামে কেউ এলে বলবেন
নিত্যকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় একটু উত্তেজিত হয়েই বললেন, আমার নাম প্রশান্ত মুখার্জী।
নিত্য একটু হেসে বলল, ও! আপনি খুলনায় যাবেন?
–হ্যাঁ।
-খুলনা থেকে আপনার আত্মীয় গাড়ি নিয়ে ওপারে অপেক্ষা করছেন।
-তাই নাকি! অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় যেন আশাই করেন নি।
গাড়ি আসার খবর শুনেই যেন মাসীমা হতাশ হলেন। বললেন, আপনি তো গাড়িতে চলে যাচ্ছেন। আমাদের বোধহয় স্টীমারে চড়িয়ে দেওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব হবে না?
-না, না, তা কেন হবে না? তাছাড়া গাড়ি যখন এসেছে, তখন আপনাদেরও সঙ্গে নিয়ে যাব।
মেসোমশাই বললেন, কিন্তু গাড়িতে কী জায়গা হবে?
অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় বললেন, একজনের বেশী নিশ্চয়ই আসে নি। সুতরাং জায়গা না হবার কী আছে?
ওদের কথা শুনেই নিত্য অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়কে বলল, আপনি বরং একবার দেখে আসুন। ওকে এই কথা বলেই একজন কনস্টেবলকে বলল, নগেন, তুমি প্রফেসার সাহেবকে ওপারের ওসি সাহেবের কাছে নিয়ে যাও। আর বলবে, উনি ওঁর গাড়িটা দেখে ফিরে আসবেন।
দশ-পনের মিনিট পরই অধ্যাপক ফিরে এসে খুশির হাসি হেসে বললেন, অনেক দিন পর যাচ্ছি বলে আমার ছোট মামা আর দুই মামাতো ভাই আমাকে নিতে এসেছেন। এবার উনি মাসীমার দিকে তাকিয়ে বললেন, যে গাড়ি এসেছে, তাতে আমরা তিনজন ধরে যাব বলেই মনে হয়।
মেসোমশাই বললেন, আমরা গেলে বোধহয় আপনাদের সবাইকেই কষ্ট দেওয়া হবে।
-কষ্ট আবার কী! মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের তো পথ।
জয়ন্তী বললেন, বনগাঁ লোক্যালের চাইতে বেশী কষ্ট কী হবে?
ওর কথায় আমরা হাসি।
এবার নিত্য ওদের তিনজনের পাসপোর্ট কনস্টেবল নগেনের হাতে দিয়ে বলল, এদের তিনজনকে পৌঁছে দিয়ে এসো, আর বলো, এরা আমার লোক।
জয়ন্তী সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমিও যাই।
নিত্য বলল, আরে দাঁড়ান দাঁড়ান। এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? জলে তো পড়েন নি।
–কিন্তু..
–কিছু কিন্তু করার কারণ নেই। বসুন বসুন।
আমি বললাম, নিত্য, আমি ওদের গাড়িতে চড়িয়ে দিয়ে আসতে পারি?
-কেন পারবে না? নিত্য সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলো, আমিও যাই।
আমরা দুজনে পা বাড়াতেই জয়ন্তী বললেন, আমিও কী ওদের সী-অফ করতে যেতে পারি?
নিত্য এক গাল হাসি হেসে বলল, অধিকন্তু ন দোষায়।
হাজার হোক ও-সি সাহেব নিজে এসেছেন। নিমেষে কাস্টমস-এর বৈতরণী পার হলো এদিকে-ওদিকে। ওদিকের ও-সিও ছুটে এলেন কাস্টমস কাউন্টারে। নিত্যর সামনে এসে উনি বললেন, নগেন এলেই তো হতো। আপনি আবার কষ্ট করে এলেন কেন? তারপর ওসি মহীউদ্দীন সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, আপনি কী ভাবলেন, আপনার বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়-স্বজনকে আমরা হ্যারাস করব?
নিত্য হাসতে হাসতে বলল, আপনাদের আত্মীয়-স্বজনকে যখন আমরা হ্যারাস করি, তখন আপনারাও ..
ওদের কথা শুনে কাস্টমস-এর তিন-চারজন ইন্সপেক্টর হো-হো করে হেসে উঠলেন।
হাসি থামলে নিত্য একজন কাস্টমস ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার বৌমার তেল ফুরোবার আগেই আমাকে বলো।
ঐ ইন্সপেক্টর কিছু বলার আগেই অন্য একজন ইন্সপেক্টর নিত্যকে বললেন, স্যার, ইসাক নতুন বিয়ে করেছে বলেই ওর বউ জবাকুসুম মাখবে আর আমি দুবছর আগে ঘরে বউ এনেছি বলে
নিত্য ঘাড় ঘুরিয়ে ডান দিকে তাকিয়ে বলল, শুনছ ইসাক তোমার বন্ধু কী বলছে? যে ছোট ভাই বিয়ের সময় বড় ভাইকে নেমন্তন্ন করতে ভুলে যায়, তার কী শাস্তি হওয়া উচিত?
এবারও ইসাক কিছু বলার আগেই ডানদিকের কোণা থেকে কাস্টমস-এর একজন মহিলা কর্মী মন্তব্য করলেন, পর পর সাত দিন পদ্মার ইলিশ খাওয়ানো।
মহা খুশি হয়ে নিত্য বলল, ঠিক বলেছেন আপা।
মাসীমা-মেসোমশাই, অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়, জয়ন্তী ও আমি অবাক হয়ে ওদের হাসাহাসি কথাবার্তা শুনছিলাম। এবার অধ্যাপক, মুখোপাধ্যায় দুদিকের দুই ওসিকে বললেন, আপনাদের মধ্যে যে এত ভাল সম্পর্ক তাতো আমরা ভাবতেও পারি না।
জয়ন্তী বললেন, সত্যিই তাই।
নিত্য কিছু বলার আগেই ওপারের ও.সি. বললেন, এই বর্ডারের পোস্টিং-এ যে কি ঝামেলা আর টেনশন, তা আপনারা ভাবতে পারবেন না। আমাদের সম্পর্ক ভাল না হলে তো আমরা কাজই করতে পারব না।
অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় বললেন, তা ঠিক।
কাস্টমস-এর ঘর থেকে বেরুবার আগে নিত্য একটু চিৎকার করেই বলল, ইসাক, তোমার বন্ধুকে বলে দিও পদ্মার ইলিশ না খাওয়ালেও এবার থেকে ঠিক জায়গায় ঠিক সময় জবাকুসুম নিয়মিত পৌঁছে যাবে।
ঐ তরুণ ইন্সপেক্টরটিও সবাইকে শুনিয়ে বলে, ইসাক, তুইও তোর দাদাকে জানিয়ে দে, জবাকুসুম মেখে আমার বউয়ের মাথা ঠাণ্ডা থাকলে দাদা তার এই অধম ভাইয়েরই উপকার করবেন।
ওর কথায় এরের সবাই হেসে ওঠেন।
পার্ক সার্কাসের মাসীমা-মেলোমশাই ও অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়ের বিদায় সম্বর্ধনা ভালই হলো। মেসোমশাই দুদিকের দুই ওসিকেই বার বার ধন্যবাদ জানালেন। বললেন, বর্ডার পার হওয়া নিয়ে সত্যি ভয় ছিল এবং এই ভয়ের জন্যই পার্টিশন হবার পর আর এদিকে আসিনি।