–ও!
–ও আম্মাকে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে রেখে ওপারের চেকপোস্ট-কাস্টমস এর কাজ সেরে নেয়। চেকপোস্ট-কাস্টমস এর কেউ ভাবতেও পারেনি ওর সঙ্গে আর কেউ আছে।…
–তাছাড়া ঐ দুর্যোগের রাত্তির।
-হা; তাই তো ওরা কেউ বাইরের দিকে নজর দেয় নি। নিত্য একটু থেমে বলে, তাছাড়া সে রাত্রের যা অবস্থা ছিল, তাতে বাইরে কেউ থাকলেও কিছুই দেখতে পেতো না।
আইন বলে, অমনভাবে কেউ কোন দেশে ঢুকলে তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। থানা পুলিস-হাজতের হুজ্জোত পার হবার পর শুরু হবে কোটকাছারির পর্ব। তারপর লাল উঁচু পাঁচিল দেওয়া সরকারী অতিথিশালায় কিছুকাল সরকারী আতিথ্য উপভোগের পর একদিন ওপারের পুলিসের হাতে তুলে দিতে হবে। যারা চুরি করে যাতায়াত করেও ধরা পড়ে না, তাদের কথা আলাদা কিন্তু ধরা পড়লেই এই দীর্ঘ নরক যন্ত্রণা!
না, চেকপোস্টের ও-সি হয়েও নিত্য আইন মানতে পারে নি। একে কিশোরী, তারপর ঐ নিষ্পাপ করুণ দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে নিত্য ভুলে গিয়েছিল ও চেকপোস্টের ও-সি। আইন-কানুনের ধারা উপধারার কথা মুহূর্তের জন্যও মনে আসে নি। রাবেয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর বার বার শুধু একটা কথাই মনে হলো, মেয়েটা বেঁচে থাকলে বোধহয় এর মতই সুন্দর, এর মতই বড় হতো।
আপনি আমায় মারবেন না, আপনি আমায় জেলে দেবেন না। আব্বা, আপনি আমায় বাঁচান।
ওর চোখের জল দেখে নিত্যর চোখেও জল এসেছিল। কোনমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, তোমাকে আমি মারব কেন মা? আমি না তোমার আব্বা? তুমি আমার আম্মা?
চেকপোস্টের ও-সি হয়েও নিত্য সেই মহাদুর্যোগের রাত্রিতেই চোরের মত লুকিয়ে লুকিয়ে হাজির হয়েছিল ওপারের ওসি সাহেবের কোয়ার্টারে। তারপর ওর দুটি হাত ধরে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, দাদা, আমার মেয়েকে আপনি বাঁচান। আপনি না বাঁচালে তাকে আত্মহত্যা করে মরতে হবে।
নিত্যকে শান্ত করে সবকিছু শোনার পর উনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, আপনার মেয়ের কী আমি কেউ হই না? দাদা বলে যখন ডাকেন, তখন অত ভাবার কী আছে? পুলিসে চাকরি করি বলে কী আমিও মানুষ না?
সেই দুর্যোগের রাত্রিতে দুদেশের আইন-কানুনই অসংখ্য সরকারী নথিপত্রের মধ্যে কোথায় যে পড়ে রইল। তা কেউ জানতেও পারলেন না। রাবেয়া দুরাত বেনাপোলে কাটাবার পর আবার ও রংপুরের বাড়িতে ফিরে গেল।
এদিক দিয়ে রংপুরের কেউ গেলেই নিত্য ওর মেয়ের জন্য কিছু না কিছু পাঠাবেই। এবারও জয়ন্তীর সঙ্গে খুব সুন্দর একটা শাড়ি পাঠিয়েছে। সুযোগ পেলে রাবেয়াও তার নতুন আব্বা আর বড় চাচার জন্য কিছু পাঠাতে ভুলে যায় না।
সব শোনার পর আমি নিত্যকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি মেয়েকে দেখতে যাও?
নিত্য ম্লান হাসি হেসে মাথা নেড়ে বলল, আমরা শুধু মানুষের আসা-যাওয়া দেখি; নিজেরা কখনও যাই না।
–সেকি! মেয়েকে দেখতেও যাওনি?
-না ভাই! নিত্য হঠাৎ একটু উজ্জ্বল হাসি হেসে বলল, মেয়েকে বলেছি, নাতি কোলে করে আসতে।
নিত্য আমার আর জয়ন্তীর সামনে বসে থাকলেও মনে হলো, সে যেন কোন স্বপ্নরাজ্যে, আনন্দের অমরাবতীতে চলে গেছে। ঘুষখোর পুলিস অফিসার হয়েও নিত্যর চোখের কোণায় দুফোঁটা জল চিকচিক করছে দেখে আনন্দে খুশিতে আমার মন ভরে গেল।
.
পরের দিন সকালে বনগাঁ লোক্যালে চড়বার সময় নিত্য আমার কানে কানে বলল, এই কদিন অনেকের অনেক কিছুই তো শুনলে কিন্তু তুমি তোমাদের বিষয়ে কিছু বললে না।
ওর কথা শুনে আমার হাসি পায়। বলি, আমি আবার কী বলব?
এবার নিত্য হাসতে হাসতে একটু জোরেই বলে, দেখ বাচ্চু, সবকিছু চোখেও দেখা যায় না, কানেও শোনা যায় না কিন্তু তবু তারা ঘটে। ঘটবেই।
আমি শুধু হাসি।
ওর মুখে তখনও হাসি। বলে যায়, ওরে বাপু, ইচ্ছে করি না বলেই সব ক্রিমিন্যালকে ধরি না কিন্তু তার মানে এ নয় যে ক্রিমিনালদের আমরা চিনতে ভুল করি।
আমি কিছু বলবার আগেই জয়ন্তী জিজ্ঞেস করেন, কী ব্যাপার দাদা?
নিত্য জবাব দেবার আগেই ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে। গাড়ির চাকা ঘুরতে শুরু করে। নিত্য ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে এগুতে এগুতে ওকে বলে, বাচ্চু সব বলবে। আর হ্যাঁ, নেমন্তন্ন করতে ভুলবেন না।
জয়ন্তী চাপা হাসি হাসতে হাসতে আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন।