আমি জয়ন্তীর কথা শুনে অবাক হয়ে নিত্যর দিকে তাকিয়ে বলি, তোমার মেয়ের খবর উনি আনলেন কী করে?
নিত্য জবাব দেবার আগেই জয়ন্তী ওকে বলেন, সে কী? আপনি আপনার বন্ধুকেও মেয়ের কথা বলেন নি?
নিত্য একটু লজ্জিত হয়েই বলে, না, বলা হয় নি।
জয়ন্তী বললেন, থাক, আপনাকে আর বলতে হবে না, আমিই ওকে বলব।
কদিন ধরেই দিনরাত বৃষ্টি হচ্ছিল। শনিবার বিকেলের দিকে সেই সঙ্গে শুরু হলে তুমুল ঝড়। সীমান্তের দুদিকেই যে কত বড় বড় গাছপালা ভেঙে পড়ল তার ঠিক ঠিকানা নেই। আশেপাশের গ্রামের অধিকাংশ কাঁচা বাড়িরই চাল উড়ে গেল। বহু পাকা বাড়িরও কম ক্ষতি হলো না।
চেকপোস্টের শিবুবাবু তিন সপ্তাহ পর গত বৃহস্পতিবার বাড়ি গিয়েছেন। অফিসের কাজেই এসআই পৃথ্বীশবাবুকে শুক্রবার সকালে কলকাতা পাঠাতে হয়েছে। ওদের দুজনেরই শনিবার বিকেলের মধ্যে ফেরার কথা কিন্তু সন্ধ্যে পর্যন্ত তাদের কোন পাত্তা নেই।
সন্ধ্যে ঘুরে যাবার পর এ-এস-আই নিরঞ্জনবাবু নিত্যকে বললেন, স্যার, ওদের দুজনের কেউই তো এখনও এলেন না।
নিত্য একটু চিন্তিত হয়েই বলল, হ্যাঁ, তাইতো দেখছি। -মনে হয়, এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে ওরা ফিরতেও পারবেন না।
–কোথাও হয়ত তার-টার ছিঁড়ে গেছে। তাই ট্রেন চলছে কিনা, তাই বা কে জানে!
–তাও হতে পারে স্যার!
ঠিক এমন সময় খুব জোরে বাজ পড়তেই আলো নিভে গেল। নিত্য বলল, বোধহয় বনগাঁ শহরের কাছাকাছিই বাজ পড়ল। কার সর্বনাশ হলো কে জানে।
কনস্টেবলরা সঙ্গে সঙ্গে লণ্ঠন জ্বেলে দেন। নিরঞ্জনবাবু এবার বলেন, স্যার, ওরা দুজনের কেউই যদি না আসেন তাহলে রাত্রে কী আমরাই থেকে যাব?
-হা হা, আমিই দেব। এবার ও একটু হেসে বলে, রাত্রে আপনার ডিউটি দিলে সকালেই আপনাদের হাসপাতালে পাঠাতে হবে।
কিছুক্ষণ পর নিত্য একবার ওপারে গিয়ে চেকপোস্টে ওসি সাহেব ও কাস্টমস্ এর সবাইকে বলে এলেন, শিববাবু আর পৃথ্বীশবাবু ফিরে আসেন নি, বলে রাত্রে আমিই ডিউটিতে থাকব। মনে হয় না, এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে কেউ আসবে। তবু ভাই, আপনারা একটু খেয়াল রাখবেন।
ওরা সবাই ওকে সব রকম সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বললেন, কোন পাগল ছাড়া আর কেউ আজ ঘর থকে বেরুবে না।
নিত্য হাসতে হাসতে বলে, পাগল এলে তো আমাদের কাজ আরো বেড়ে যাবে।
নিত্য খেয়েদেয়ে ডিউটিতে আসার পর ঝড়ের বেগ সামান্য একটু কমলেও আরো জোরে বৃষ্টি শুরু হলো। ঘরের দরজা আগেই বন্ধ ছিল কিন্তু এবার জানালা খুলে রাখাও অসম্ভব হয়ে উঠল। টেবিলটা আরো খানিকটা দূরে সরিয়ে রথীন বললেন, স্যার, জানালা দিয়ে বড় বেশি জল আসছে।
–কী আর করা যাবে? জানালা বন্ধ করলে তো কিছুই দেখা যাবে না।
কনস্টেবল রথীন একটু হেসে বললেন, স্যার, আজকে জানালার সামনে দিয়ে কেউ গট গট করে হেঁটে গেলেও আমরা তাকে দেখতে পাব না।
নিত্যও হাসে। বলে, তা ঠিক।
রাত সাড়ে-দশটা-এগারোটা নাগাত বাঞ্ছা কোনমতে এক মগ ভর্তি চা পৌঁছে দিয়েই বলল, স্যার, ঘরে এত জল পড়ছে যে আর চা তৈরী করা সম্ভব হবে না।
–ঠিক আছে। কি আর করা যাবে।
রাত এগিয়ে চলে। ঝড়-বৃষ্টির মাতলামিও সমান তালে চলতে থাকে। নিত্য চেয়ারে বসে টেবিলের উপর দুটো পা তুলে দিয়ে সিগারেট টানে। দুজন কনস্টেবল চুপচাপ বসে বসে ক্লান্ত হয়। মাঝে মাঝে একটু ঝিমুনিও ধরে। সময় যেন কাটতে চায় না।
তবু সময় এগিয়ে চলে।
লণ্ঠনের আলোয় একবার হাতের ঘড়িটা দেখে নিত্য একটু জোরেই বলে, কী রথীন, ঘুমুলে নাকি? মোটে তো পৌনে বারোটা বাজে।
–না স্যার, ঘুমোই নি।
–আলো থাকলে তবু একটু গল্পের বই-টই পড়া যেতো।
–হ্যাঁ, স্যার।
অন্য কনস্টেবলটি বললেন, পঞ্চার দোকানটা খোলা থাকলে তবু একটু চা পাওয়া যেতো।
নিত্য একটু হেসে বলে, কপাল যখন মন্দ হয়, তখন এইরকমই হয়।
বড় জোর আধঘণ্টা হবে। নিত্য একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। হঠাৎ রথীনের চিৎকার শুনেই ও লাফ দিয়ে উঠল। চার ব্যাটারীর তিনটে টর্চের আলোর সামনে মেয়েটি পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে পড়ল কিন্তু কে একজন যেন ঐ অন্ধকারের মধ্যেই দৌড়ে পালাল।
জয়ন্তী একটু থামে। একবার বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়। তারপর বলে, আপনার বন্ধু এক লাফে মেয়েটির সামনে হাজির হতেই ও হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ওর দুটো পা জড়িয়ে ধরল…
..আপনি আমাকে বাঁচান। আপনি আমার আব্বু, আপনি, আমার আম্মা! আপনি আমাকে বাঁচান।
এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর নিত্য বলল, সত্যি বাচ্চু, এমন নিষ্পাপ করুণ মুখ আমি জীবনে দেখিনি।…
জয়ন্তী বললেন, ঠিক বলেছেন। আমিও ওকে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। এবার উনি নিত্যর দিকে তাকিয়ে বললেন, সেদিন আপনি রাবেয়াকে না বাঁচালে ওর কপালে যে কি দুঃখ ছিল, তা ভগবানই জানেন।
এবার আমি প্রশ্ন করি, সেদিন রাত্রে ওর কী হয়েছিল?
নিত্য বেশ গম্ভীর হয়েই বলে, ভাই, আমাদের এইসব দেশে সরল মেয়েদের সর্বনাশ করার লোক কী কম? ও একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলেই আবার বলে, ও হারামজাদাটাকে তো ধরতে পারলাম না কিন্তু আম্মার কাছে সব শুনে মনে হলো, ও একটা অতি বদমাইশ স্মাগলারের খপ্পরে পড়েছিল।
-তাই নাকি?
-তাই তো মনে হয়।
–কিন্তু ওরা ওভাবে পালাচ্ছিল কেন?
–ও হতচ্ছাড়ার একটা ইণ্ডিয়ান পাসপোর্ট ছিল। সেই পাসপোর্ট দেখিয়েই ও বেনাপোল পার হয় কিন্তু আম্মার তো পাসপোর্ট ছিল না।