আমিও জয়ন্তীর কথামতই সাত তারিখে এসেছি। ও না বললে হয়ত দুএকদিন এদিক ওদিক কাটিয়ে আসতাম। মনে মনে কোন স্বপ্ন না দেখলেও ওর সান্নিধ্যের লোভ নিশ্চয়ই ছিল। এই দুদিন নানাজনের সান্নিধ্যে সব সময় ওর কথা মনে করার সুযোগ না পেলেও বার বার বহুবার ওর কথা ভেবেছি। ভাবতে ভাল লেগেছে। না ভেবে পারিনি।
মনে মনে কত কি ভেবেছিলাম। ভেবেছিলাম প্রায় নির্জন যশোর রোডের আলোয় ছায়ায় আমরা দুজনে কত ঘুরব, কত কথা বলব আর শুনব। হয়তো আরো কিছু ভেবেছিলাম।
না, না, ভালবাসিনি কিন্তু শীতের আগে হেমন্তের শেষে শিশির ভেজা সকালে যেমন সামান্য শিহরণ অনুভূত হয়, অনেকটা সেই রকম চাপা ভাল লাগার ক্ষীণ অনুরণন বোধহয় মনের এক নিভৃত পল্লীতে জেগে উঠেছিল।
ওর মধ্যে কার যেন একটা প্রতিচ্ছবি, কোন এক হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির এমন প্রতিবিম্ব দেখেছি যে তারই আশায় কী সোনার হরিণের পিছনে আমার মন ছুটেছে?
মনের মধ্যে যাই হোক, আমি কখনও কিছু প্রকাশ করিনি, করা সম্ভব নয়। তাই তো একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেই নিত্যকে বললাম, হাজার হোক বাবা-মার কাছে গেছে। কবে ফিরবে, তার কি কোন ঠিক-ঠিকানা আছে?
-না, না, ও সাত তারিখেই ফিরবে বলছিল। নিত্য একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তাছাড়া ও জানে, আমি একজনের খবরের জন্য বসে আছি।
এবারও যেন নিত্য পুরো কথাটা বলল না। মনে হলো, কিছু কথা ওর মনের মধ্যেই লুকিয়ে রইল। আমিও ওকে কোন প্রশ্ন করলাম না।
সকালবেলায় নিত্য কোনদিনই গল্পগুজব করার বিশেষ সময় পায় না। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করার জন্য দুদিনই সকালে উঠতে দেরি হয়েছে। তাই আজকেও ও তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে চেকপোস্টে চলে গেল।
নিত্য চলে যাবার পর একটা সিগারেট শেষ করার আগেই অমিত আর নিবেদিতা হাসতে হাসতে আমার ঘরে ঢুকল। আমি ওদের দেখেই প্রশ্ন করি, সকালে ঘুম থেকে উঠেই দাদার কথা মনে পড়ল?
অমিত বলল, আজ থেকে তো আমার নাইট ডিউটি শুরু। তাই বাড়িতে বসে না থেকে আপনার এখানে চলে এলাম।
নিবেদিতা ফ্লাস্ক ভর্তি চা এনেছিল। ফ্লাস্ক থেকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বলল, আপনাকে তো রোজ রোজ পাব না, তাই ভাবলাম, একটু বিরক্ত করে আসি।
-আমি সকাল থেকে মাঝ রাত্তির পর্যন্ত তোমাদের সবাইকে বিরক্ত করছি। তাতেও কী তোমার আশ মেটে নি?
নিবেদিতা আমার হাতে চায়ের কাপ তুলে দিতে দিতে একটু হেসে বলল, আপনার বিরক্ত করার দৌলতে তবু আমরা একঘেয়েমি থেকে একটু মুক্তি পেয়েছি।
অমিত বলল, ঠিক বলেছ।
চা খেতে খেতে আমরা তিনজনে কথা বলি। আমার আর অমিতের পেয়ালা খালি হতেই নিবেদিতা আবার ভরে দেয়। ঐ পেয়ালার চা শেষ হতে না হতেই একটা টিফিন বক্স আর ফ্লাস্ক হাতে নিয়ে রেখা নিবেদিতার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই তো ভারী স্বার্থপর! আমাকে না ডেকেই নিজের বরকে নিয়ে দাদার কাছে চলে এলি?
অমিত বলল, দোষটা ওর নয়, আমার। আমিই ওকে…
রেখা টেবিলের উপর টিফিন বক্স আর ফ্লাস্ক রাখতে রাখতে বলল, সে আমি জানি। আপনার সংসর্গে যে নিবেদিতা দিন দিন খারাপ হচ্ছে, তা কী আমরা জানি না।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, দুঃখ করো না রেখা। আমার সংসর্গে তোমরা সবাই খারাপ হয়ে নিবেদিতার সমান সমান হয়ে যাবে।
ওরা তিনজনে হাসতে হাসতে প্রায় একসঙ্গেই বলে, না, না, দাদা, আপনি কাউকেই খারাপ করবেন না।
রেখার আজ ছুটি। তাই সকালবেলাতেই আড্ডাটা বেশ জমে ওঠে। ওরই মধ্যে চিড়ের পোলাও আর একবার চা হয়ে যায়। ডিউটিতে যাবার পথে অরূপ শাসিয়ে যায়, বাচ্চুদা, সন্ধ্যে ছটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত আমি আর আপনি দরজা বন্ধ করে গল্প করব। কোন আলতু-ফালতু ছেলেমেয়ে সেখানে ঢুকতে পারবে না।
রেখা হাসি চেপে বলল, ঠিক বলেছ অরূপদা! নিবেদিতার মত আজেবাজে মেয়েকে আমাদের আড্ডায় ঢুকতে না দেওয়াই উচিত।
-থাক, থাক, আর ন্যাকামি করতে হবে না। কথাটা শেষ করতে না করতেই অরূপ ঘরের বাইরে পা বাড়ায়।
আমাদের আসর আবার জমে ওঠে। কোথা দিয়ে যে একদেড় ঘণ্টা সময় পার হয়ে যায়, তা আমরা কেউই টের পাই না। হঠাৎ হাসতে হাসতে নিত্যকে ঘরে ঢুকতে দেখেই অবাক হয়ে যাই। সকালবেলায় যাকে গম্ভীর মুখে অফিস যেতে দেখলাম, তার মুখে এত হাসি দেখে অবাক হব না? আমি কিছু বলার আগেই ও পিছন ফিরে বলল, দেখুন, দেখুন, বাচ্চু কি রকম আড্ডা জমিয়েছে।
ঘরের দরজায় পা দিয়েই জয়ন্তী এক পলকের জন্য আমার দিকে তাকিয়েই নিত্যকে বলল, আপনার বন্ধু এখানে আছেন, তা তো এতক্ষণ বলেননি?
–সরি।
যাবার দিনই অমিতের সঙ্গে জয়ন্তীর পরিচয় হয়েছিল। তাই অমিত নিবেদিতা আর রেখার সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দেয়। রেখা সঙ্গে সঙ্গে ওকে এক কাপ চা দিয়েই বলে, চিড়ের পোলাও ফুরিয়ে গেছে বলে দিতে পারলাম না বলে রাগ করবেন না।
এবার জয়ন্তী আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলেন, বেশ সুখেই আছেন দেখছি।
–আপনি ছিলেন না বলেই সুখে ছিলাম।
ভয় নেই, আজ দুপুরের ট্রেনেই পালাচ্ছি।
নিত্য চা খেতে খেতে বলল, আজকে তোমাদের কাউকেই ছাড়ছি না। কাল সকালের ট্রেনে দুজনেই এক সঙ্গে চলে যেও।
জয়ন্তী সঙ্গে সঙ্গে ওকে বলল, আমি না হয় আপনার মেয়ের খবর এনে দিয়েছি বলে খাতির পেতে পারি কিন্তু ওকে আটকাচ্ছেন কেন?