-উনি রবীন্দ্রনাথের খুব ভক্ত ছিলেন, তাই না?
-হ্যাঁ, ভাই। আয়েষা ওর ক্ষণস্থায়ী বসন্তের স্মৃতি রোমন্থন করে প্রচ্ছন্ন গর্বের হাসি হেসে বলে, বাদশা তোমাদের কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজের অত্যন্ত নামকরা ছাত্র ছিল। তাছাড়া এম. এ তে সেবার ও একাই ফার্স্ট ক্লাস পায়। এল-এস-ই-তে ভর্তি হবার পর অবসর সময় শুধু সঞ্চয়িতা পড়েই কাটাত।
কেয়া একটু হাসে।
-হাসছ কী ভাই? আমার সঙ্গে আলাপ হবার আগে ঐ বিদেশে সঞ্চয়িতাই ছিল ওর একমাত্র বন্ধু। মদ তো দূরের কথা, বাদশাকে কোনদিন একটা সিগারেট পর্যন্ত খেতে দেখি নি।
আয়েষা একটু থেমে বলে, ওর দেড় বছর বয়েসের সময় ওর আব্বা মারা যান। আম্মা অনেক দুঃখে কষ্টে ওকে বড় করেন। তাই তো আম্মা দুঃখ পান, এমন কোন কিছু ও করত না কিন্তু ..
আয়েষা হঠাৎ থেমে যায়। মুখ নীচু করে কি যেন ভাবে। কেয়াই প্রশ্ন করে, কিন্তু কী?
আয়েষা মুখ না তুলেই মাথা নাড়তে নাড়তে বিড়বিড় করে, ছোটবেলা থেকে আম্মাকে কোনদিন কোন ব্যাপারে দুঃখ দাও নি বলেই বোধহয় এক আঘাতেই সব পাওনা মিটিয়ে দিলে; তাই না?
অনেকক্ষণ কেউই কোন কথা বলে না। বোধহয় এইভাবেই দশ পনের মিনিট কেটে যায়। তারপর কেয়া জিজ্ঞেস করে, আম্মা কোথায় আছেন?
–তিলজলার কবর থেকে ফেরার পর আম্মা আর বেনেপুকুরের বাড়িতে ফিরে যান নি।
–আর ফিরে যান নি?
এবার আয়েষা মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলে, না ভাই, আম্মা আজো ফিরে আসেন নি। খুব জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আম্মা নিশ্চয়ই ছেলের কাছেই চলে গেছেন, নরক যন্ত্রণা ভোগ করছি শুধু আমি।
হরিদাসপুর সীমান্ত দিয়ে দুদেশের কত অসংখ্য নারী পুরুষ যাতায়াত করেন কিন্তু তাদের মনের কথা, প্রাণের দুঃখের হদিস পায় না চেকপোস্ট কাস্টমস-এর কর্মীরা। সম্ভবও নয়। সুখ দুঃখের কথা জানাবার বা জানবার গরজই বা কার হয়?
কদাচিৎ কখনও ব্যতিক্রম ঘটে বৈকি! হাজার হোক সবাই তো মানুষ!
যাত্রীদের মত চেকপোস্ট-কাস্টমস-এর লোকজনদেরও তো হৃৎপিণ্ড ওঠা-নামা করে। সুখ দুঃখ প্রেম ভালোবাসা বিরহ বেদনার অনুভূতি তো সব মানুষেরই আছে। রক্ত মাংসের দেহ তো এর উর্ধ্বে যেতে পারে না!
কথায় কথায় অনেক রাত হয়েছিল। দুজনেই শুয়ে পড়ে। মুখোমুখি শুয়ে থাকলেও কেউ কোন কথা বলে না, বলতে পারে না। নিশুতি রাতের কোলে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ে।
হঠাৎ কী কারণে যেন কেয়ার ঘুম ভেঙে যায়। বারান্দা থেকে ভেসে আসে
জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে,
বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে।
এ মোর হৃদয়ের বিজন আকাশে
তোমার মহাসন আলোতে ঢাকা সে…
না, আয়েষা আর পারে না, হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে, বাদশা, আমাকে তুমি কাছে টেনে নাও লক্ষ্মীটি! আমি আর পারছি না বাদশা…
কেয়া এক চুল নড়তে পারে না। সাহস হয় না। প্রাণহীন মর্মর মূর্তির মত বিছানায় বসে বসেই শুধু চোখের জল ফেলে।
.
০৯.
অধিকাংশ মানুষই মানুষের কাছ থেকে পালিয়ে অরণ্য-পর্বত সমুদ্রের কাছে ছুটে যায় শান্তির আশায়, আনন্দের লোভে, বৈচিত্রের সন্ধানে। কিন্তু মানুষের কাছে যে শান্তি, যে আনন্দ ও বৈচিত্র্য কখনও কখনও পাওয়া যায়, তা কি অন্যত্র সম্ভব?
প্রকৃতির লীলাক্ষেত্রে মৌনী হিমালয়, আকাশচুম্বী বনানী, অশান্ত দুরন্ত সমুদ্র নিশ্চয়ই এক একটি বিস্ময় কিন্তু সব বিস্ময়ের শেষ কী মানুষ না? আমাদের আশেপাশেই চেনা, অচেনা মানুষই তো পরম বিস্ময়।
লণ্ডন না, নিউইয়র্ক না, রোম, প্যারিস মস্কোও না, দিল্লী বা হাতের কাছের করাচীতেও না, এই হরিদাসপুর বেনাপোল সীমান্ত চেকপোস্টের দুএকটি রাত কাটিয়ে সেই চিরসত্যকে আবার নতুন করে উপলব্ধি করলাম।
বাংলাদেশ যাবার সময় নিত্য যখন আমাকে ফেরার পথে এখানে কয়েকদিন কাটাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, তখন প্রস্তাবটি বিশেষ লোভনীয় মনে হয় নি। বোধহয় মনে মনে একটু হাসিও পেয়েছিল। ভেবেছিলাম, একি দার্জিলিং, না ওটি বা নৈনিতাল যে নিত্য এমন করে আমন্ত্রণ করছে?
মনে মনে ইচ্ছা অনিচ্ছার দোল খেতে খেতেই বেনাপোলের ওসি সাহেবের কাছে পাসপোর্ট ছাপ লাগাবার জন্যই গিয়েছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাসপোর্টের ছাপকে ম্লান করে মনের ছাপই অনেক অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সীমান্তের পাশে দুটি দিন কাটাবার পর আজ মনে হচ্ছে, এই ত এলাম। মাত্র এই দুটি দিনের মধ্যেই কী সীমান্তের দুদিকের খাকি পোশাক পরা মানুষগুলোকে ভালবেসে ফেলেছি?
জানি না। শুধু এইটুকু বুঝতে পারছি, এদের সান্নিধ্য আমার ভাল লাগছে। এদের ছেড়ে যেতেও ঠিক উৎসাহ বোধ করছি না। একেই কি ভালবাসা বলে? নাকি বন্ধুত্বের লোভ, সান্নিধ্যের মোহ?
নিত্য এই দুদিন আর ওদের ব্যারাকে থাকেনি; ডিউটির সময়টুকু ছাড়া আমার সঙ্গে থাকারই চেষ্টা করেছে। রাত্রে আমার সঙ্গেই কাস্টমস কলোনীর গেস্ট হাউসে থাকে। দুটো খাটে মুখোমুখি শুয়ে আমরা কত গল্প করি।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই নিত্যকে চুপ করে বসে থাকতে দেখেই জিজ্ঞেস করলাম, কী হলো? সকালে উঠেই কী এত ভাবছ?
-ভাবছি জয়ন্তীর কথা।
–জয়ন্তীর কথা? -হঠাৎ ওর কথা ভাবছ কেন?
ও আগের মত গম্ভীর হয়েই বলল, পাঁচ সাত তারিখের মধ্যেই ফিরবে বলেছিল কিন্তু ..
নিত্য কথাটা শেষ না করেই কি যেন ভাবে।