-কেন?
–কেন আবার? আমাকে এফ. আর. সি. এস. পড়াবার জন্য সবাই মেতে উঠলেন।
সত্যি আয়েষার বিলেত যাবার তেমন ইচ্ছে ছিল না। হাজার হোক বাবা-মার একমাত্র সন্তান। ওদের ছেড়ে অত দূরে যেতে মন চাইছিল না। কিন্তু আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ডাঃ করিম পর্যন্ত এমন করে বললেন যে আয়েষা অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে রাজী হলো। তারপর একদিন অপরাহ্ন বেলায় ঢাকা থেকে রওনা হয়ে করাচী-রোম-প্যারিস ডিঙিয়ে লণ্ডন হাজির হলো।
সময় তো কোন কারণেই অপেক্ষা করতে জানে না, পারে না। দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল কত দিন কত মাস। আয়েষা সত্যি সত্যি একদিন এডিনবরা থেকে এফ. আর. সি. এস. হয়। রেজাল্ট বেরুবার পরদিন সকালেই ডাঃ ম্যাক্সওয়েল ওকে বললেন, নো, নো, আয়েষা, আমি এখনই তোমাকে ঢাকা ফিরতে দেব না। তুমি অ্যাট লিস্ট বছর দুই আমার সঙ্গে কাজ করবে।
পৃথিবী বিখ্যাত অত বড় সার্জেনের এমন আমন্ত্রণে আয়েষা নিজেকে ধন্য মনে করে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার জন্য মনপ্রাণ বাকুল হয়ে ওঠে।
–লুক হিয়ার আয়েষা, আমি ডেফিনিটলি জানি বছর দুয়েক আমার সঙ্গে কাজ করলে তুমি রিয়েলি আউটস্ট্যাণ্ডিং সার্জেন হবে।
আয়েষা শুধু বলেছিল, অ্যাজ ইউ প্লীজ স্যার!
ডাঃ ম্যাক্সওয়েল দুহাত দিয়ে ওর ডান হাতটা চেপে ধরে বলছিলেন, আমি জানতাম, তুমি আমার রিকোয়েস্ট টার্ন ডাউন করবে না।
লণ্ডনের অন্যতম প্রাচীন ও বিখ্যাত সেন্ট টমাস হাসপাতালে আয়েষার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়।
আয়েষা খুব জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেয়াকে বলল, জানো ভাই, ঐ লণ্ডনে এসেই আমার সর্বনাশ হলো।
-কেন?
বাঙালীদের নববর্ষ অনুষ্ঠানে কয়েকটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার পরই একজন ইয়াংম্যান আমাকে এসে কী বলল জানো?
-কী বললেন?
ঘন কালো মেঘের ফাঁক দিয়েও যেন ঈষৎ সূর্যরশ্মি দেখা দেয়। আয়েষা একটু হাসে। বোধহয় সেদিনের স্মৃতি রোমন্থন করেও একটু সুখের পরশ অনুভব করে।
–শুনলাম ডাঃ ম্যাক্সওয়েলের আণ্ডারে সেন্ট টমাস হসপিট্যালে কাজ করছেন?
–হ্যাঁ।
উনি আয়েষার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে একটু হেসে বলেন, আল্লা আর কি কি গুণ আপনাকে দিয়েছেন বলতে পারেন?
ওর কথায় আয়েষা একটু না হেসে পারে না। জিজ্ঞেস করে, তার মানে?
— এমন রূপ যে তাকাতে ইচ্ছে করে না, এমন বিচ্ছিরি গান গাইলেন যে কেউ হাততালি দিল না, তার উপরে হাতুড়ে ডাঃ ম্যাক্সওয়েলের জুনিয়র!
যে বাঙালী ছেলেমেয়েরা দেশে থাকতে সহজভাবে মেলামেশা করতে পারে না, তারাই বিদেশে গিয়ে কত পাল্টে যায়। যাবেই। পরিবর্তিত সামাজিক পরিবেশে এই পরিবর্তন নিতান্তই স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিতও। তাই ওর কথায় আয়েষা বিস্মিত হয় না। তবে মনে মনে ভাবে, এত মানুষ গান শুনলেও ঠিক এই ধরনের অভিনন্দন তো আর কেউ জানালেন না।
কেয়াকে অত্যন্ত আপনজন ভেবেই আয়েষা বলেন, বিশ্বাস করো কেয়া, সেদিনের আগে কোনদিন কখনও এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি, কাউকে ভালোবাসি বা এমন কাউকে দেখিনি যাকে ভালবাসতে ইচ্ছে করেছে। সেদিন সেই মুহূর্ত থেকে আমি রশীদের ভালোবাসায় ভেসে গেলাম।
কেয়া একটু হেসে বলল, কোন না কোনদিন তো মানুষের জীবনে বাঁধ ভাঙবেই ভাই।
-তা ঠিক, কিন্তু আগে তো তা ভাবতাম না।
-তারপর?
আয়েষা একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, বেশীদিন না, বছর দেড়েক মাত্র। স্বপ্ন দেখতে দেখতেই কেটে গেল।
.
লণ্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের ছাত্র হয়েও রশীদ যে এমন গান পাগল হবে, তা আয়েষা ভাবতে পারে নি। পার্লামেন্ট হিল-এ বসে অনেকক্ষণ অনেক কথা বলার পর রশীদ আয়েষার একটা হাত আলতো করে নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, জানো বেগম, আমি কী স্বপ্ন দেখি?
–কী?
রশীদ একটু চুপ করে থাকে। তারপর সবুজের মেলায় দৃষ্টি ছড়িয়ে প্রায় আনমনেই বলে, আমি মারা যাবার পাঁচ-দশ মিনিট পর তুমি মারা যাবে।
আয়েষা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, হঠাৎ এ কথা বলছ কেন?
–কেন আবার? মানুষ হয়ে যখন জন্মেছি, তখন মরতে তো হবেই। রশীদ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, কিভাবে বেঁচে থাকব, তা যদি ভাবা যায়, তাহলে মারা যাবার বিষয়েই বা ভাবতে বাধা কী?
কিন্তু তুমিই বা আগে মরবে কেন আর আমিই বা তার পাঁচ দশ মিনিট পর মরব কেন?
-কেন আবার? মরবার সময় তোমার গান শুনব না? রশীদ নির্বিকারভাবে বলে।
আয়েষা ওর কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায়। বিস্মিত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি যখন মারা যাবে, তখন আমি গান গাইব?
-হ্যাঁ, বেগম, আমি মারা যাবার সময় তুমি গাইবে, জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে।
-বাদশা, তুমি একটা বদ্ধ পাগল!
বর্ষণক্লান্ত শ্রাবণ সন্ধ্যার আকাশে মুহূর্তের জন্য বিদ্যুতের আলোর মত আয়েষার মুখেও ঈষৎ হাসির রেখা একবার যেন উঁকি দেয়, বলে, সত্যি কেয়া, বাদশা একটা আস্ত পাগল ছিল। এক একদিন কী বলত জানো?
কেয়া মুখে কিছু বলে না, শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
-বলতো, বেগম, আজ কোন কথা বলব না, শুধু তোমাকে প্রাণভরে দেখব। আবার কতদিন ও গান শোনার পর কিছু খাওয়া দাওয়া না করেই ঘুমিয়ে পড়তো।
-কেন?
–কেন? ও বলতো, রবি ঠাকুরের এইসব গান শুনলে এমন মন ভরে যায় যে আর খাওয়া-দাওয়ার ইচ্ছই করে না।