আমি জয়ন্তীর দিকে তাকিয়ে চাপা হাসি হেসে বললাম, যাক, আপনার সঙ্গে ঝগড়া করে বেশ সময়টা কেটে যাবে।
উনি হাসতে হাসতেই বললেন, শুধু কাজকর্মে না, ঝগড়াঝাটির ব্যাপারেও মেয়েদের খ্যাতি অনেক খ্যাতি।
ওঁর কথায় আমরা সবাই হাসি।
বনগাঁ পৌঁছবার আগেই আমাদের কজনের মধ্যে বেশ আলাপ পরিচয় জমে উঠল। পার্ক সার্কাসের মাসীমা বললেন, বড্ড ভয়ে ভয়ে রওনা হয়েছিলাম। এখন আপনাদের পেয়ে একটু ভরসা পাচ্ছি।
আমি হেসে বলি, আপনি তো আচ্ছা লোক মাসীমা। আমাদের এতজনকে পেয়েও আপনার একটু মাত্র ভরসা হচ্ছে?
উনি লজ্জিত হয়ে বললেন, না, না, বাবা, তা না। সেই দেশ ছাড়ার পর তো আর যাই নি, তাই মনে মনে বড্ড ভয় ছিল। তাছাড়া আমরা দুই বুড়োবুড়ি যাচ্ছি তো..
অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কোথায় যাবেন?
মাসীমা আর মেসোমশাই প্রায় একসঙ্গে বললেন, আমরা যাব বরিশাল।
–খুলনা থেকে স্টীমারে যাবেন তো?
হ্যাঁ।
–আমি আপনাদের স্টীমারে চড়িয়ে দেব।
মাসীমা বোধহয় মনে মনে ঈশ্বরকে স্মরণ করেই বললেন যাক, তাহলে আর চিন্তা কী? বরিশালে তো মেয়ে-জামাই নাতি-নাতনীরা স্টীমার ঘাটে থাকবে।
এবার জয়ন্তী ওদের জিজ্ঞেস করলেন, বরিশালে বেড়াতে যাচ্ছেন?
মাসীমা একটু হেসে বললেন, মেজ নাতনীর বিয়ে। বড় নাতির বিয়েও মাস দেড়েকের মধ্যে হতে পারে। তাই….
আমাদের নেমন্তন্ন করবেন না? জয়ন্তী হাসতে হাসতে প্রশ্ন করেন।
চলো না মা, তোমরা সবাই চল। তোমরা সবাই গেলে ওরা খুব খুশি হবে। মাসীমা একটু আত্মপ্রসাদের হাসি হেসে বললেন, আমার জামাইবাড়ির উপর লক্ষ্মী-সরস্বতী দুজনেরই কৃপা আছে। তোমরা গেলে ওদের কোন অসুবিধা হবে না।
পত্রপত্রিকাগুলো বের করলেও পড়া হয় না কারুরই। আমরা সবাই গল্পগুজবে মেতে থাকি। গল্পগুজব মানে নিজেদের আলাপ পরিচয়ই একটু ভালভাবে হয়। মেসোমশাই রেলের ডি. এস. হয়ে রিটায়ার করেছেন অনেকদিন আগে। কর্মজীবনে বহু বছর কাটিয়েছেন পূর্ববাংলায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লাতেই অধিকাংশ সময় থাকলেও কয়েক বছর রংপুরেও ছিলেন। সব ছেলেমেয়েদের জন্মই ওদিকে। দুমেয়ের বিয়েও দিয়েছিলেন ঐদিকেই। বড় মেয়ে বরিশালে থাকে, মেজ মেয়েটি আছে ঢাকায়। বাকী সব এদিকে। বেশ সুখের সংসার ছিল কিন্তু গত বছর মেজ জামাইটির হঠাৎ ক্যান্সার ধরা পড়ার পর মাস তিনেকও বাঁচল না। মাসীমা পাঁজর কাঁপানো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বেশী দিন বেঁচে থাকলে কপালে এসব দুঃখ থাকবেই। আবার কোনমতে একটু নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, কপালে আরো কত দুঃখ আছে, তা ঠাকুরই জানেন।
জয়ন্তী বললেন, ওকথা বলছেন কেন মাসীমা? অল্প বয়সে কি মানুষ দুঃখ পায় না?
পায় বৈকি মা! কিন্তু যত বেশী দিন বাঁচা যাবে, তত বেশী কষ্ট পেতে হবে।
আমি চুপ করে শুনি। আমি মাসীমা-মেসোমশায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ওদের বুকের ক্ষতের আন্দাজ করি।
জয়ন্তী একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, মাসীমা, সুখ-দুঃখ বোঝার কি কোন বয়স আছে?
এতক্ষণ নীরব থাকার পর মেসোমশাই বললেন, ঠিক বলেছ।
বনগাঁ লোক্যাল এগিয়ে চলে। হকারের স্রোতে ভাটার টান হয়। আমি আর অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় সিগারেট ধরাই।
একটা স্টেশন আরো পার হয়। এবার মাসীমা জয়ন্তীকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় যাবে মা?
-আমি এখন রংপুর যাব।
–ওখানে তোমার কোন আত্মীয়-স্বজন আছেন?
–আমার বাবা ওখানেই থাকেন। এখন মাও ওখানে আছেন।
-তাই নাকি?
—হ্যাঁ।
-তুমি কলকাতায় থাক?
–আমরা তিন ভাইবোন আর মা কলকাতায় থাকি।
মাসীমা আবার প্রশ্ন করেন, বাবা মাঝে মাঝে আসেন?
–কোট বন্ধ থাকলেই বাবা কলকাতায় চলে আসেন।
উনি একলা একলাই ওখানে থাকেন?
না, না, আমার দুই কাকাও ওখানে আছেন। তাছাড়া মা মাঝে মাঝেই যান।
ওরা কথা বলেন। আমরাও আমাদের মধ্যে কথাবার্তা বলি। হঠাৎ একবার কানে এলো মাসীমার কথা, স্কুলে পড়ান ভাল কাজ কিন্তু বিয়ে করবে কবে?
ইচ্ছা করল জয়ন্তীর দিকে তাকাই কিন্তু দ্বিধা হলো। লজ্জা করল। অধ্যাপক মুখোপাধ্যায়ের দিকে তাকিয়ে জয়ন্তীর উত্তর শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে রইলাম।
উনি জবাব দিলেন, সবাই কী বিয়ে করে?
ছেলেরা বিয়ে না করেও থাকতে পারে কিন্তু মেয়েদের কী তা সম্ভব?
বনগাঁ পৌঁছবার দশ-পনের মিনিট আগে আমি মাসীমাকে জিজ্ঞেস করি, কী মাসীমা, কেমন লাগছে?
মাসীমা খুশির হাসি হেসে বললেন, তোমাদের মত ভাল ছেলেমেয়ে পাবার পরও কী খারাপ থাকতে পারি?
তাই বলুন। আমি হাসি চেপে বলি, বিশেষ করে আমার প্রশংসা না করে উপায় নেই।
আমার কথায় শুধু ওঁরা না, আরো দুএকজন হাসেন। হাসি থামলে তির্যক দৃষ্টিতে আমার দিকে একবার দেখে নিয়ে জয়ন্তী বলেন, সব চাইতে আমি ভাল, তাই না মাসীমা?
জয়ন্তীর প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই ট্রেন বনগাঁ স্টেশনে ঢোকে। অধ্যাপক মুখোপাধ্যায় মাসীমাকে জবাব দেবার সুযোগ না দিয়েই বলেন, আমার মত ভাল মানুষ হয় না, তাই না মাসীমা?
এতক্ষণ নীরব থাকার পর মেসোমশাই বলেন, তোমাদের মাসীমার কাছে তোমরা কেউই ভাল না, শুধু আমি ভাল।
আমরা সবাই হো-হো করে হেসে উঠি।
.
০২.
দুই ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের ও-সি সাহেবের নাম যাত্রীসাধারণের অবগতির জন্য কাঠের ফলকে অত সুন্দর করে লেখা থাকলেও আমার নজরই পড়েনি। ওসি সাহেবের নাম জানার প্রয়োজনও বোধ করিনি। দারোগাবাবুরা কে কোথায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন, তা জানতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। চেকপোস্টে বড় দানোগা বাবু সম্পর্কে আমার সামান্যতম আগ্রহ বা উৎসাহ ছিল না বলেই বোধহয় অমন করে জড়িয়ে পড়লাম।