আয়েষা একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, না ভাই, ওসব দেখতে আর ইচ্ছে করে না।
না, কেয়া আর প্রশ্ন করে না। উচিত মনে করে না। কিন্তু মনে মনে ভাবে, এই বয়সেই এমন বৈরাগ্য কেন? কত বয়স হবে? তিরিশ-বত্রিশ। খুব বেশী হলে চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ। বোধহয় অত হবে না। হয়ত বিয়েও করেননি। তাছাড়া অমন রূপ!
শুধু কেয়া না, অন্য মেয়েরাও ওর দিকে না তাকিয়ে পারে না। অতি সাধারণ একটা ছাপা শাড়ী আর সাদা ব্লাউজ। মাথায় আলতো করে বাঁধা একটা খোঁপা। না, কানে-গলায়-হাতে কোন অলঙ্কার নেই। বাঁ হাতে একটা বড় ঘড়ি। ব্যস! আর কিছু নেই।
বাহুল্য তো দূরের কথা। তবু ওকে এমন অপরূপা মনে হয় যে দুটো চোখ টেনে নেবেই। সুন্দর ও সৌন্দর্যের বৈশিষ্ট্যই এখানে। চাপা চামেলী-জুই যেখানেই থাকুক, তাদের সৌন্দর্য-সৌরভে অন্তত মুহূর্তের জন্যও মানুষ একটু আনমনা হবেই।
কেয়া ওকে কিছুই জিজ্ঞেস করে না। দুএক মিনিটের মধ্যেই কাস্টমস-এর কাজ শেষ হয়। বিদায়ের প্রাক্কালে কেয়া শুধু বলে, আবার আসবেন।
–আসব বৈকি! এখানে না এসে আর কোথায় যাব? আয়েষা একটু হেসেই জবাব দেন কিন্তু সামান্য হাসিতেও ঐ মুখে যে ঔজ্জ্বল্য কেয়া আশা করেছিল, তা দেখা গেল না। ভোল্টেজ কম থাকলে দুশ একশ পাওয়ারের বালবও যেমন টিমটিম করে জ্বলে, ঠিক তেমন আর কি!
কেয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলল, প্রথম কয়েকবার যাতায়াত করার সময় কিছুই জানতে পারিনি। শুধু পাসপোর্ট দেখে জেনেছিলাম, উনি বহুদিন বিদেশে ছিলেন। আর উনি ডাক্তার।
–আর কিছুই জানতে পারো নি?
-না। একটু থেমে বলল, তবে ওকে দেখে এইটুকু আন্দাজ করেছিলাম, কোথায় যেন একটা ব্যথা লুকিয়ে আছে কিন্তু উনি প্রকাশ করতে চান না।
দিন চলে যায়, মাস ঘুরে যায়। কত শত সহস্র যাত্রী হরিদাসপুর সীমান্ত দিয়ে যাতায়াত করেন। ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে তাদের পাসপোর্টে ছাপ পড়ে। কাস্টমস-এর লোকজনের সঙ্গে ভাব ভালোবাসা জমাতে চান। যাত্রীদের সঙ্গে অহেতুক বকবক করতে চেকপোস্ট-কাস্টমস-এর কর্মীদেরও তেমন গরজ হয় না কিন্তু কখনো কখনো ব্যতিক্রম ঘটে বৈকি!
–আরে আপনি! কেয়া আয়েষাকে দেখেই হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ায়।
কাউন্টারের উপর হ্যাণ্ডকাপ রেখেই আয়েষা ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কেমন আছেন ভাই?
–ভাল। মুহূর্তের জন্য একটু থেমেই কে জিজ্ঞেস করে, আপনি?
খুব ভাল আছি। কৃষ্ণপক্ষের গভীর অন্ধকার রাত্রে কোন চিরদুঃখীর বেহালায় যে কান্নার সুর ভেসে আসে, আয়েষার কথায় ঠিক তেমনি বেদনার ছোঁয়া পায় কেয়া। একবার ওর দিকে তাকায়। বোধহয় ওর বেদনার ইঙ্গিত পাবার চেষ্টা করে। না, না, অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চায় না। তাই শুধু জিজ্ঞেস করে, এবারও কী আজমীঢ় যাচ্ছেন?
-না, ভাই, এবার শুধু কলকাতায় যাচ্ছি।
–কিছুদিন থাকবেন তো?
কেয়ার পাশের চেয়ারে বসতে বসতে উনি বলেন, শুধু কালকের দিনই থাকবে। পরশুই ফিরব।
কেয়া অবাক হয়ে বলে, সেকি? মাত্র একদিনের জন্য কলকাতা যাচ্ছেন?
আয়েষা ঠোঁটের কোণায় ঈষৎ হাসির রেখা ফুটিয়ে বলেন, কালকেই আমার কাজ। তারপর শুধু শুধু কী করতে থাকব? একটু থেমে কেয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন, তাছাড়া একলা একলা কী করব বলুন?
কেয়া কিছু বলার আগেই উনি আবার বলেন, আপনি চলুন আমার সঙ্গে। দুচারদিন বেশ একসঙ্গে কাটান যাবে।
এ সংসারে সবাই কিছু কিছু মানুষের সান্নিধ্য পাবার জন্য কাঙাল। মনের এই বাসনা কখনো পূর্ণ হয়, কখনো হয় না, কখনো কেউ প্রকাশ করে, কখনো আবার অপ্রকাশিতই থেকে যায়। মনের ইচ্ছা মনের মধ্যেই চাপা থাকে। আয়েষার সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠ হবার সাধ কেয়ার মনের মধ্যে নিশ্চয়ই ছিল। তাই তো সে দুএকজন ইন্সপেক্টরের সঙ্গে কথা বলেই দৌড়ে সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের কাছে গেল।
কয়েক মিনিট পরেই কেয়া ঘুরে এসে বলল, আপনি যদি বিকেলের দিকে যান, তাহলে আমিও যেতে পারি। ও একটু থেমে বলল, আমিও বহুদিন কলকাতায় যাই না।
আয়েষা বললেন, আপনি যদি যান, তাহলে কেন বিকেলে যাব? আজ রাত্তিরের মধ্যে কলকাতায় পৌঁছলেই হলো।
.
ফুল আর মালা নিয়ে তিলজলার কবরখানায় ঢোকার আগেই আয়েষা মনে মনে বললেন, আস্সালাতত ইয়া আহলুল করবে হে পবিত্র কবরবাসীরা, তোমাদের প্রতি ঈশ্বর শান্তি বর্ষণ করুন।
তারপর ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে গিয়ে ফুল আর মালায় ঢেকে দিলেন সারা কবরটা। জ্বেলে দিলেন ধূপ। হাঁটু ভেঙে বসে দুহাত পেতে মোনাজাত করলেন কতক্ষণ। মোনাজাত শেষ হবার পরও উনি ওঠেন না। উঠতে পারেন না। নীরবে চোখের জল ফেললেন আরো কতক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে কেয়াকে বললেন, চলুন, ভাই।
কেয়া সঙ্গে সঙ্গে এগুতে পারে না। ঐখানে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করল, এটা কার কবর?
–আমার শত্রুর।
কেয়া কোন কথা না বলে ওর দিকে তাকাতেই উনি অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, যে আমার সারা জীবনের সমস্ত আনন্দ কেড়ে নিয়েছে, যার জন্য আমাকে চিরকাল শুধু চোখের জল ফেলতে হবে, সে শত্রু না?
কেয়া আর কোন প্রশ্ন করে নি কিন্তু মর্মে মর্মে অনুভব করেছিল ওর মনের ব্যথা ও ভালবাসার গভীরতা।
তিলজলা কবরখানা থেকে ফেরার পরও বিশেষ কোন কথা হয় নি; তবে সেদিন রাত্রে আর আয়েষা না বলে পারে নি।-ফাইন্যাল এম. বি. বি এস-এ রেজাল্ট ভালই হলো। তাছাড়া সার্জারীতে একটা গোল্ড মেডালও পেলাম। আয়েষা একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আর ঐ গোল্ড মেডাল পাওয়াই আমার কাল হলো।