-আজ্ঞে হ্যাঁ, এই!
-সুন্দরীর সৌন্দর্ষসুধায় যে পুরুষ মুগ্ধ হয় না, সে আবার পুরুষ নাকি?
জয়শ্রী বলল, ঠিক বলেছ!
এই কাস্টমস কলোনীর অস্থায়ী বাসিন্দা হয়েও আমিও নানা জনের কোয়ার্টারে ঘুরে বেড়াই। চা খাই, গল্প করি, ওদের কথা শুনি।
মেয়েদের মধ্যে কেয়াই সব চাইতে বেশী দিন এখানে আছে। কথায় কথায় আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, বছরের পর বছর ধরে পোটলা-পুটলি বাক্স বিছানা খুলে দেখতে বা এটা-ওটা নিতে পারবেন না বলতে বিরক্ত লাগে না?
কেয়া একটু হেসে বলল, একঘেয়েমি বা বিরক্ত যে লাগে না, তা বলব না; তবে বৈচিত্র্যও তো আছে।
–বৈচিত্র্য মানে নানা ধরনের মানুষ দেখা তো?
–মানুষ ছাড়াও কী কম বৈচিত্র্য? কেয়া কলোনীর সামনে যশোর রোডের উপর আমার সঙ্গে পায়চারি করতে করতে বলে, মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা কটা জিনিস দেখতে পারে বা জানতে পারে? কিন্তু এই কবছর কাস্টমস-এ কাজ করে আমি কত রকমের কত কি যে দেখলাম ও জানলাম, তার ঠিক-ঠিকানা নেই।
আমি মাথা নেড়ে বলি, তা ঠিক।
কেয়া একটু হেসে বলে, আগে জানতাম মদ বলে একটা তরল পদার্থ আছে, যা খেলে নেশা হয় কিন্তু তার বেশী কিছু জানতাম না।
আমি একটু হেসে জিজ্ঞেস করি, আর এখন?
-এখন আমি পঞ্চাশ-ষাট রকমের হুইস্কি-ভদকা-জিন, কনিয়াক লিকুয়্যার-পোর্ট-শেরী ইত্যাদির নাম শুধু গড় গড় করে বলতে পারি না, কার কি রকম বোতল ও দাম, তাও মুখস্থ।
আমি শুধু হাসি।
-সত্যি বাচ্চুদা, এই হরিদাসপুর বর্ডারের কাস্টমস-এ চাকরি করতে গিয়ে সারা পৃথিবীর কত কি জানলাম আর দেখলাম। কেয়া একবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এইসব দেখা জানা ছাড়াও কত রকমের মানুষ দেখি।
-তা ঠিক।
–কিছু কিছু মানুষের সঙ্গে তা আমাদের এমন ভাব হয়ে গেছে যে তারা আত্মীয়ের চাইতেও অনেক বেশী।
-তাই নাকি?
–হ্যা বাচ্চুদা। কেয়া একটু থেমে বলে, ব্যবসাদার ছাড়াও দুদিকের বেশ কিছু মানুষই নিয়মিত এখান দিয়ে যাতায়াত করেন। তাদের প্রায় সবাইকেই আমরা চিনি, আর কয়েকজন সত্যি আমাদের আত্মীয় বন্ধু হয়ে গেছেন।
সেদিন রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর কেয়া এদেরই একজনের কথা আমাকে বলেছিল।
হরিদাসপুর-বেনাপোল সীমান্ত সেই ভোরবেলা থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত প্রায় সব সময়ই সরগরম থাকে। আসা-যাওয়া লেগেই আছে। তবু মাঝে মাঝে কখনও-সখনও হঠাৎ একটু ঝিমিয়ে পড়ে। কোন অদৃশ্য অজানা কারণে এই নিত্য ব্যস্ত সীমান্ত দিয়ে হঠাৎ মানুষের আসা যাওয়া থেমে যায়। দুদিকের সীমান্তের কাস্টমস ও চেকপোস্টের সব কর্মীদের কাছেই এই অপ্রত্যাশিত অবসর বড়ই প্রিয়, বড়ই মধুর।
হবে না কেন? সরকারী অফিসে কাজ করলে নির্বিবাদে বলা যায়, আপনার ফাইল এখনও ফিনান্স থেকে আমাদের কাছে আসে নি। আপনি কাইন্ডলি সামনের সপ্তাহে একবার আসবেন। ভদ্রলোককে অত ঘোরাতে না চাইলে স্বচ্ছন্দে বলা যায়, আপনি লাঞ্চের পর আসুন। আশাকরি, তার মধ্যে চিঠিটা তৈরী হয়ে যাবে।
সীমান্ত চেকপোস্টে এসব বিলাসিতার কোন অবকাশ কর্মীদের নেই। শুধু তাই নয়। এদের ক্যালেণ্ডারে লালএর স্পর্শ নেই। বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষদের জন্মদিন মৃত্যুদিন, কোন ধর্মীয় উৎসব, স্বাধীনতা-প্রজাতন্ত্র দিবস থেকে রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু হলেও সীমান্তের কাস্টমস-ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের ঝাঁপ বন্ধ হয় না। এক কথায় ছুটি বা লাঞ্চ ব্রেক বলে কোন শব্দ এদের ডিক্সনারীতে থাকে না। দেশের মধ্যে যুদ্ধ লাগলে অবশ্য সবার আগে সীমান্তের দরজায় তালা পড়ে।
যাই হোক, এমনই এক অবসরের সময় ওরা সবাই মিলে চা খেতে খেতে গল্প করছিলেন। হঠাৎ একজন মহিলা ধীর পদক্ষেপে কাস্টমস কাউন্টারে ঢুকে হাতের ব্যাগটা নীচে রেখে একবার কেয়ার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। কেয়া চা খেতে খেতেই হাত বাড়িয়ে বলল, পাসপোর্টটা দিন।
ভদ্রমহিলা পাসপোর্ট ওর হাতে দিয়েই বললেন, আপনারা চা খেয়ে নিন। আমি অপেক্ষা করছি।
চা খেতে খেতেই আমাদের কাজ করতে হয়।
-আমার জন্য ব্যস্ত হবেন না। পাঁচ-দশ মিনিট অপেক্ষা করলে আমার কোন ক্ষতি হবে না।
এ ধরনের কথা তো কেউ বলেন না। কেয়া একটু অবাক হয়। খুশি হয়ে বলে, তাহলে আপনিও একটু চা খান।
-না, না, তার কি দরকার?
সামান্য এক কাপ ছাড়া তো কিছুনয়, অত আপত্তি করছেন কেন?
এইভাবেই প্রথম আলাপ। দিন পনের বাদে উনি আবার দেশে ফেরার পথে সীমান্তে হাজির। সেদিনও কেয়া ডিউটিতে।
–কী, এরই মধ্যে দেশে ফিরে যাচ্ছেন?
-হ্যাঁ, ভাই।
-কোথায় কোথায় ঘুরলেন?
–আমি তো শুধু আজমীঢ় শরীফ আর কলকাতার জন্যই এসেছিলাম।
কেয়া চা-বিস্কুট আনতে দিয়ে আবার প্রশ্ন করে, আজমীঢ় যখন গিয়েছিলেন, তখন দিল্লী-আগ্রা-জয়পুর নিশ্চয়ই দেখেছেন?
-না ভাই; আমি আর কিছু দেখিনি।
কেয়া অবাক হয়ে বলে, সে কী? এত কষ্ট, এত খরচ করে আজমীঢ় গেলেন অথচ দিল্লী-আগ্রা-জয়পুর দেখলেন না?
আয়েষা একটু ম্লান হেসে বললেন, ট্রেন বদলাতে হবে বলে আসা যাওয়ার পথে দুরাত দিল্লীতে থেকেছি ঠিকই কিন্তু কোন কিছু দেখি নি।
-কেন? কেয়া বিস্ময়ের সঙ্গে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, দেশ বিদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ লালকেল্লা কুতুবমিনার দেখতে আসে আর আপনি দিল্লীতে দুরাত কাটিয়েও…