হান্নান একটু থেমে বলেন, যাত্রাপুরের হাইস্কুলটা উনিই প্রতিষ্ঠা করেন। আর ঐ কলেজের প্রিন্সিপ্যাল তো আমার সেই বড় ভাই।
-তাই নাকি?
হান্নান হেসে বলেন, হ্যাঁ। উনি আবার একটু থেমে আবার একটু হেসে বলেন, স্যারের নাতি-নাতনীরা ওঁকে এত ঘন ঘন দেশে যেতে বারণ করলে উনি কি বলেন জানেন?
-কী?
–স্যার বলেন, ইসাক কেমন কলেজ চালাচ্ছে, তা না দেখলে চলে?
কথাগুলো বলতে বলতে গর্বে হান্নান সাহেবের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। হঠাৎ উনি একটু জোরে হেসে উঠে বললেন, স্যার কিন্তু স্মাগলিংও করেন।
তার মানে?
কলেজের এক বুড়ো জমাদারের জন্য উনি এক থলি ভর্তি বিড়ি নিয়ে যান।
–বিড়ি?
–হ্যাঁ, হ্যাঁ, বিড়ি। আমাদের দেশে তো কাগজের বিড়ি। তাই আমাদের দেশে ইণ্ডিয়ান বিড়ির দারুণ চাহিদা!
আমি হো-হো করে হেসে উঠি।
.
০৮.
কাস্টমস কলোনী সত্যি ভাল লাগল। হরিদাসপুর সীমান্ত চেকপোস্টের কলকাকলি থেকে বেশ দূরে স্নিগ্ধ গ্রাম্য পরিবেশে সুন্দর ও আধুনিক এই কলোনী। কটেজের মত ছোট ছোট কোয়ার্টার। স্বচ্ছন্দে থাকার মত সব সুযোগ-সুবিধাই আছে। কলোনীর এক দিকে যশোর রোড। অন্য তিন দিকেই সবুজের মেলা। ভারত সরকারের নথিপত্রে কর্মচারীদের শ্রেণী বৈষম্যের উল্লেখ থাকলেও এই কলোনীর বাসিন্দাদের মধ্যে তার নগ্ন প্রকাশ নেই।
সন্ধ্যের পর সুপারিটেনডেন্ট সাহেব ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে একটু জোরেই বলেন, কী বিভা, তোমাদের কী চা খাওয়া হয়ে গেছে?
তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে ইন্দিরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে বলেন, আসুন স্যার, ভিতরে আসুন। বিভাদি এই মাত্র বাথরুমে ঢুকল।
ছোট্ট দুখানি ঘরের কোয়ার্টার। চারজনে মিলে মিশে থাকেন। ড্রইংরুম বলে কিছু নেই। প্রয়োজনও নেই, সম্ভবও না। সুপারিটেন ডেন্ট সাহেব একটা তক্তপোশের উপর বসেই ইন্দিরাকে জিজ্ঞেস করেন, আজ কে রান্না করছে?
রেখা।
–ও! উনি একটু থেমে জিজ্ঞেস করেন, কেয়া কোথায়?
–তেওয়ারীদা তো ডিউটিতে গিয়েছেন। তাই ও মুন্নীকে নিয়ে ঘুরছিল তো!
সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব হাসতে হাসতে মাথা নেড়ে বললেন, তাহলে মুন্নী না ঘুমোন পর্যন্ত ও আসছে না।
ইন্দিরাও একটু হাসেন। বলেন, আমাদের ভিতরের ঘরে ঘোষদার বাচ্চাটা ঘুমোচ্ছে। ওকে ঘুম পাড়াবার জন্যই তো বিভাদি এত দেরিতে বাথরুমে গেল।
–জয়শ্রীর কী শরীর খারাপ?
-না, না জয়শ্রী বৌদি আর ঘোষদার বোন একটু কেনাকাটা করতে বনগাঁ গেছেন বলে বাচ্চাটাকে আমাদের কাছে ..
সুপারিনটেনডেন্ট সাহেব হেসে বলেন, ওরা বেশ আছে। যখন তখন বাচ্চাদের তোমাদের কাছে রেখে ঘুরছে ফিরছে।
ইন্দিরাও একটু হেসে বলেন আমাদেরও এমন অভ্যাস হয়েছে যে একটা না একটা বাচ্চা না থাকলে কোয়ার্টারটা বড় খালি খালি লাগে।
রেখা চা নিয়ে আসেন। একটু পরে বিভাও আসেন। সবাই মিলে গল্পগুজব করে আরো পনের-বিশ মিনিট কেটে যায়।
খাকি পোশাক পরে সারাদিন এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কন্টোল অর্ডার আর ব্যাগেজ রুলস্-এর গায়ত্রী জপ করলেও ইন্সপেক্টর অমিত সরকার সন্ধোর পর প্রায় শেষের কবিতার অমিত রায় হয়ে যান
যারা কথা বলে তাহারা বলুক,
আমি কাহারেও করি না বিমুখ,
তারা নাহি জানে-ভরা আছে প্রাণ।
তব অকথিত বাণীতে।
ঠিক সেই মুহূর্তে নিবেদিতা বাইরের ঘরে পা দিয়েই স্বামীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলে
নীরবে নিয়ত রয়েছ আমার
নীরব হৃদয়-খানিতে
কোনদিন স্বামী-স্ত্রীতে মিলে কবিতা বা গান নিয়েই কাটিয়ে দেন সারা সন্ধ্যেবেলা। কোনদিন আবার অজয় ঘোষ, বিমান ব্যানার্জী, জয়শ্রী, বিভার এলে গান-বাজনা নাটক-নভেল কবিতা নিয়ে তর্ক বিতর্কের আসর জমে ওঠে। অরূপ ঘরে ঢুকলেই উল্টোদিকে স্রোত বইতে শুরু করে!
অরূপ নিবেদিতার দিকে তাকিয়ে, চাপা হাসি হেসে বলে, ওহে নন্দনকাননবাসিনী সুন্দরী, স্বামীকে নিয়ে তো মত্ত হয়ে আছ কিন্তু মহাপ্রভু আজ কী করেছেন জানো?
সবাই ওর দিকে তাকায়।
নিবেদিতা বলে, আপনি না বললে জানব কী করে?
–ঢাকার বিখ্যাত শিল্পপতি আশরাফউদ্দীন আমেদের নাম নিশ্চয়ই শুনেছ?
–হ্যাঁ, দুএকবার শুনেছি।
–ওঁর স্ত্রী রামপুরের নবাববাড়ির মেয়ে, তা কী জানো?
-না, তা জানি না।
–তা না জানলেও বেগম সাহেব যে পরমা সুন্দরী, তা তো জানো?
–না, তাও জানি না।
অরূপ একটা মোড়ায় বসতে বসতে বলে, যাই হোক আশরাফউদ্দীন আমেদ ও তার ফ্যামিলির অনেকেই আমাদের এদিক দিয়ে যাতায়াত করেন, তা তো জানো?
নিবেদিতা একবার এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে বলে, অত শত না জানলেও আশরাফউদ্দীন সাহেব আপনাদের সবাইকে খুব ভালবাসেন, তা জানি।
অরূপ মাথা নেড়ে বলল, ভেরী গুড! পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বলল, অদ্য অপরাহ্ন তিন ঘটিকার সময় আশরাফউদ্দীন সাহেবের এক পরমা সুন্দরী কন্যা আমাদের দেশে পদার্পণ করেন।
ওর কথায় অনেকেই মুখ টিপে হাসে। নিবেদিতা বলল, কত সুন্দরী, কত কুৎসিতই তো আসছে; তাতে আমার কী?
–তোমার কিছু ব্যাপার না থাকলে কী শুধু শুধুই এ খবর দিচ্ছি? ও একবার ভাল করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলে, শুধু এই কথাটাই আপনাকে জ্ঞাত করতে চাই যে ঐ পরমা সুন্দরীর সঙ্গে শ্রীমান অমিতের ভালোবাসা না হইলেও গভীর ভাব হইয়াছে, সে বিষয়ে কাহারও বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই।
চাপা হাসির গুঞ্জন ওঠে চারদিক থেকে, নিবেদিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ও! এই!