হরিদাসপুর-বেনাপোল দিয়ে যারা যাতায়াত করেন, তাদের বারো আনাই পারিবারিক পুনর্মিলনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে পার হয়ে যান।
-না, না, আব্বা, এখানে কিছু খাব না।
হামিদ সাহেব অবাক হয়ে বলেন, সে কিরে? তোর খিদে পায় নি?
সঞ্জিদা বলল, এখানে খেতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। দুলা ভাই নিশ্চয়ই ইভনিংশোর টিকিট কেটে রেখেছেন। এখন তাড়াতাড়ি চলো।
–সেই কখন বাড়ি থেকে খেয়ে বেরিয়েছিস!
–তা হোক।
সত্যি, হরিদাসপুর চেকপোস্ট পার হবার পরই সঞ্জিদা আর ধৈর্য ধরতে পারে না। খুলনা থেকে কলকাতার আমীর আলি এভিন্যু মাত্র একশ পাঁচ-দশ মাইল হলেও মনে হয় কত দূর! কিন্তু বেনাপোল ছাড়িয়ে হরিদাসপুর পার হবার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয়, এই তো এসে গেছি। ইলেকট্রিক ট্রেনে তো মাত্র দুঘণ্টার পথ শিয়ালদ’। তারপর ট্যাক্সীতে? বড়জোর দশ-পনের মিনিট।
বড় বোন সবিতার বিয়ের পর সঞ্জিদা গত দুবছর ধরে এই সময় মাস খানেকের জন্য কলকাতা আসে। তার আগেও দুএক বছর অন্তর এসেছে ছোট চাচার বাড়ি। তাই তো কলকাতা ওর কাছে ঠিক বিদেশ না।
বনগাঁ থেকে শিয়ালদ’ যাবার পথে অনেক স্টেশন পড়ে কিন্তু তাদের নাম ওর মনে থাকে না বা রাখে না। তবে জানে দমদম এলেই শিয়ালদ’ নামার উদ্যোগ-আয়োজন শুরু করতে হয়।
একলা একলা ও আমীর আলি এভিন্য যেতে না পারলেও এন্টালী মার্কেট ছাড়ালেই কেমন চেনা চেনা মনে হয় সবকিছু। ট্যাক্সী সার্কুলার রোড থেকে পার্ক স্ট্রীটে ঘুরতেই ও উত্তেজিত না হয়ে পরে না। বলে, আব্বা, এসে গেছি। ঐ তো ট্রাম ডিপোর কাছে ডান দিকে ঘুরলেই ..
হামিদ সাহেব হেসে বলেন, তুই এদিকটা বেশ চিনে গেছিস, তাই না?
-শুধু এদিক কেন, নিউ মার্কেট-চৌরঙ্গী গড়িয়াহাট, আরো কত জায়গা চিনি। সঞ্জিদা চোখ দুটো বড় বড় করে হামিদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে, দুলা ভাই অফিসে বেরুবার পরই তো আমি আর আপা বেরিয়ে পড়ি।
হামিদ সাহেব মেয়ের কথা শুনে হাসেন।
সঞ্জিদা বলে যায়, কোনদিন নিউ মার্কেট, কোনদিন গড়িয়াহাট, কোনদিন আবার ছোট চাচির কাছে যাই। দুটো-তিনটের আগে কোনদিন আমরা বাড়ি ফিরি না। তারপর সন্ধ্যের পর আমার দুলা ভাইয়ের সঙ্গে কোনদিন সিনেমা, কোনদিন থিয়েটার দেখতে যাই।
অষ্টাদশী সঞ্জিদা ভাবাবেগে, আনন্দের আতিশয্যে এসব কথা বলে যায় কিন্তু মধ্যবয়সী হামিদ চুপ করে থাকলেও তিনি মনে মনে চাপা আনন্দ ও উত্তেজনার স্বাদ অনুভব করেন। করবেন না কেন? যে কলকাতায় আসতে আজকে তার পাসপোর্ট-ভিসা লাগে, সীমান্তের দুদিকে বাক্স-পেটরা খুলে দেখাতে হয়, সেই কলকাতার মীর্জাপুর স্ট্রীটেই তো ওর জন্ম। শুধু ওর কেন? ওরা পাঁচ ভাইবোনেই তো ঐ বাড়িতে জন্মেছেন।
হরিদাসপুর সীমান্ত পার হবার পর ফেলে আসা সেই সোনালী দিনগুলোর স্মৃতিতে হামিদ সাহেবের চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। কত কি মনে পড়ে ওর! বিছানায় শুয়ে শুয়ে শিয়ালদ’ স্টেশনের রেল ইঞ্জিনের হুইসেলের আওয়াজ কী ভাল লাগত শুনতে! শ্ৰদ্ধানন্দ পার্কে ফুটবল খেলা, ভাইবোনে মিলে কলেজ স্কোয়ারে বেড়াতে যাওয়া ও এক এক পয়সার নকুলদানা খাওয়া!
সেদিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে হামিদ সাহেব আপন মনেই হেসে ওঠেন।
আরো কত কি মনে পড়ে! হরিদাসপুর চেকপোস্টের পাশেই রিকশা চড়ার সঙ্গে সঙ্গেই উনি যেন চোখের সামনে পুরনো দিনের কলকাতাকে দেখতে পান। সেই গ্যাসের আলো, সেই ভোরবেলায় রাস্তায় জল দেওয়া, ফিটন গাড়ি, অক্টারলনী মনুমেন্ট, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, জাদুঘর, চিড়িয়াখানা।
সেন্ট পলস্ স্কুল-কলেজের সহপাঠী কুমুদ এখন রাইটার্স বিল্ডিং-এ ডেপুটি সেক্রেটারী। উনি হামিদ সাহেবকে বলেন, জানিস হামিদ, এখন আর সে কলকাতা নেই। সবকিছু এত বদলে গেছে যে সেসব দিনের কথা ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়।
হামিদ সাহেব একটু ম্লান হেসে বলেন, আগে পাকিস্তানী ছিলাম, এখন বাংলাদেশী হয়েছি, খুলনায় কত বড় বাড়ি করেছি, কত দামী মোটর গাড়িতে চড়ি কিন্তু তবু কলকাতায় এসে ট্রাম দেখেই মনে হয়, লাফ দিয়ে উঠে পড়ি।
কুমুদবাবু ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন।
হামিদ সাহেব বলে যান, কলকাতা যে সে কলকাতা নেই, তা আমিও জানি কিন্তু তবু তো এই শহরে জন্মেছি, এখানেই তো লেখাপড়া শিখেছি। উনি মুহূর্তের জন্য আনমনা হয়ে বলেন, তাছাড়া এই শহরের মাটিতেই তো আম্মাকে আমরা গোর দিয়েছি।
–তোর মা মারা যাবার কথা আমি জীবনে ভুলব না। সত্যি, অমন মৃত্যু আমি আর দেখি নি।
-আমার আম্মা সত্যি ভাগ্যবতী ছিলেন। আম্মাকে সাদি করার পরই আব্বার যত উন্নতি। আর আম্মা মারা যাবার এক বছরের মধ্যেই আমাদের মীর্জাপুরের বাড়ি ছেড়ে খুলনায় চলে যেতে হলো।
এই কলকাতায় এসে হামিদ সাহেবের কাছে খুলনা যেন কত দূর, কত অপরিচিত মনে হয়।
স্রোত কখনই একমুখী হয় না, হতে পারে না।
হরিদাসপুর সীমান্ত পার হয়ে বেনাপোলের কাস্টমস কাউন্টারে মালপত্র রেখেই মধুসূদন চৌধুরী একজন কাস্টমস ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞেস করেন, হান্নান কী এখন ডিউটিতে নেই?
ইন্সপেক্টরটি একবার ভাল করে বৃদ্ধ মধুবাবু ও তার বৃদ্ধা স্ত্রীকে দেখে নিয়ে বলেন, উনি একটু ব্যস্ত আছেন।
–কাইন্ডলি ওকে একটু বলুন যে প্রফেসর চৌধুরী এসেছেন।