ভদ্রলোক বোধহয় ঈশান কোণে মেঘের ইঙ্গিত দেখতে পান।
একটু নরম সুরে বলেন, কাইন্ডলি একটু তাড়াতাড়ি করবেন। আমার খুব জরুরী কাজ আছে।
কেদারবাবু সে কথার কোন জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নাম?
পাসপোর্টে তো সবই লেখা আছে।
–আমার প্রশ্নের জবাব দিন।
–আমার নাম ইন্দুশেখর গোরে।
বাবার নাম?
আন্নাসাহেব গোরে।
-কোথায় জন্মেছেন?
নাগপুর।
কবে জন্মেছেন?
–সাতই নভেম্বর।
কোন্ সালে?
মুহূর্তের জন্য উনি একটু ঘাবড়ে গেলেও সঙ্গে সঙ্গে সামলে নিয়ে বললেন, পঁয়ত্রিশ সালে।
–ঠিক তো?
মিঃ গোরে তাড়াতাড়ি একটু হেসে বললেন, বাবার ডায়রী দেখে তো ফর্ম ভর্তি করেছিলাম।
–আপনার মুখের আঁচিলটা কোথায় গেল?
–ও! একটু ঢোক গিলে বললেন, ওটা পড়ে গেছে।
–পড়ে গেছে?
হ্যাঁ। মিঃ গোরে যেন কষ্ট করেই হেসে কথাটা বললেন।
–হঠাৎ পড়ে গেল? কেদারবাবু শ্যেন দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন।
–হ্যাঁ, হ্যাঁ, হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খেয়ে পড়ে গেছে।
এবার কেদারবাবু চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলেন, আপনি ভিতরে আসুন।
-কেন বলুন তো?
–দরকার আছে।
কেদারবাবুর কথাবার্তা শুনে দুজন কনস্টেবল সতর্ক হয়ে গেছে। ওদেরই একজন ইশারায় ঘরের বাইরের দুচারজনকে সতর্ক করে দিয়েছে।
মিঃ গোরে ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই হাতের রোলেক্স ক্রনোমিটারটি খুলে হঠাৎ কেদারবাবুর হাতে দিয়ে বললেন, প্লীজ হেলপ মী!
কেদারবাবু গর্জে উঠলেন, সতীশ, দরজা বন্ধ করো। চোখের নিমেষে দরজা বন্ধ হতেই কেদারবাবু, একটু হেসে বললেন, একশ তিরিশ টাকার এইচ-এম-টি এত ভাল সময় দেয় যে দশ বিশ হাজার টাকা দামের রোলেক্স ক্রনোমিটারের কোন দরকার নেই।
এক নিঃশ্বাসে এই পর্যন্ত বলার পর কেদারবাবু আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ঐ লোকটা কি করেছিল জানেন?
-কী?
–সপ্তমীর দিন রাত্রে বোম্বের এক ফাঁইভ স্টার হোটেলে এক বিদেশী কাপলকে মার্ডার করে সর্বস্ব লুঠ করে।
–তারপর?
–ওর যমজ ভাই এক ট্রাভেল এজেন্সীতে কাজ করে। ঐ ভাইয়ের পাসপোর্ট নিয়ে ও ভোরের প্লেনেই কলকাতা রওনা হয়। কলকাতায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাংলাদেশের একটা জাল ভিসা যোগাড় করে পালাবার জন্য. ..
–বলেন কী?
কনস্টেবল সতীশ পাশেই ছিলেন। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, জানেন স্যার, ও যদি মেজাজ না দেখাত তাহলে বোধ হয় পার হয়ে যেতো।
কেদারবাবু ওকে সমর্থন জানিয়ে বললেন, তা ঠিক। হাজার হোক যমজ ভাইয়ের পাসপোর্ট নিয়ে যাচ্ছিল। মুখের পাশের ছোট একটা আঁচিল নিয়ে কি সব সময় আমরা মাথা ঘামাই?
আমি মাথা নেড়ে বলি, তা তো বটেই।
সতীশ আবার বলেন, ওর সুটকেসের মধ্যে কী না ছিল! ঢাকা থেকে বিলেত-আমেরিকা যাবার টিকিট থেকে শুধু লাখখানেক টাকার ডলার ও কয়েক লাখ টাকার গহনা ছিল।
কেদারবাবু বললেন, গহনা মানে ডায়মণ্ডের কয়েকটা নেকলেস। আসলে ঐ বিদেশী ভদ্রলোক ডায়মণ্ডের বিজনেস করতেন। উনি ডায়মণ্ড-কাটারদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যই বোম্বে এসেছিলেন।
আমি বললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমাদের ডায়মণ্ড-কাটাররা তো পৃথিবী বিখ্যাত।
এতক্ষণ নিত্য কোন কথা বলেনি। কেদারবাবুর কথা শেষ হবার পর ও একটু মুচকি হাসি হেসে বলল, আরে ভাই, শুধু চোর-ডাকাত না, কত রথী-মহারথী ফলস পাসপোর্ট নিয়ে যাতায়াত করেন।
আমি প্রায় আঁতকে উঠি। বলি, সে কী? আমাদের দেশের বিখ্যাত লোকেরা কী করে…।
আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ও বলল, না, না, আমাদের দেশের বিখ্যাত লোকদের কথা বলছি না। দিল্লীর কিছু কিছু এম্বাসীতে এমন কিছু মহাপুরুষ আছেন যাদের ব্রীফকেসে সব সময় ডজনখানেক পাসপোর্ট মজুত থাকে।
আমি একটু হেসে বললাম, এ কারবার তো তাদেরই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়।
–তা তো বটেই।
–কিন্তু ওদের তো ধরার উপায় নেই নিত্য ছত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, আমরা একজনকে ধরেছিলাম।
-কী করে?
–ভদ্রলোক ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট নিয়ে ওদিকে গিয়েছিলেন। মাস খানেক পরে ফিরেও এলেন ঐ পাসপোর্ট নিয়ে কিন্তু ওর অনেক মালপত্তর ছিল। ভুল করে উনি একটা দড়ির ব্যাগ ফেলে বাকি সব মালপত্তর গাড়িতে তুলে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কোল্ড ড্রিঙ্ক খাচ্ছিলেন।
-তারপর?
–দশ পনের মিনিটের মধ্যে আরো অনেকে এসেছেন–গিয়েছেন। ভাবলাম, কেউ বোধ হয় ভুলে ফেলে গিয়েছেন। টেবিলের উপর ব্যাগটা পড়ে থাকতে দেখে হাতে তুলে নিতেই অবাক।
–কেন?
–দেখি, ভিতরে একটা পিস্তল আর দুটো পাসপোর্ট।
–সে কী? -আর সে কী? ভদ্রলোক ক্যাচ-কট-কট!
৭-৯. সাতচল্লিশে শুধু দেশ
সাতচল্লিশে শুধু দেশই টুকরো টুকরো হলো না, অসংখ্য পরিবারও টুকরো টুকরো হলো। ভয়ে ভীতিতে, আশঙ্কায় অথবা সদ্যসৃষ্ট স্বর্গের বাসিন্দা হবার জন্য ঘর-সংসার তুলে নিয়ে গেলেন একদিক থেকে অন্যদিকে কিন্তু সবার পক্ষে কী তা সম্ভব?
–না।
সীমান্তের দুদিকেই এমন হাজার-হাজার লক্ষ-লক্ষ মানুষ আছেন, যাদের পরম প্রিয়জনদের অনেকেই রয়েছেন সীমান্তের অপর দিকে। শ্যাম-দোয়েল-কোয়েলের ডাক শুনে আর মাটির সোঁদা গন্ধের দোষেই বোধহয় দুই বাংলার মানুষই কেমন একটু ভাবপ্রবণ হয়। হবেই। অতি বাস্তববাদী বাঙালীও প্রিয়জনের চোখে দুফোঁটা জল দেখলে বা কোকিলের ডাক শুনলে অন্তত কয়েক টুকরো মুহূর্তের জন্য আনমনা হবেনই। তাই তো তারা সুখে বা দুঃখে প্রিয়জনের সান্নিধ্য লাভ না করে থাকতে পারেন না। পাসপোর্ট-ভিসা-চেকপোস্টের ঝামেলার চাইতে এই সান্নিধ্যের আকর্ষণ অনেক অনেক বেশী।