শুধু খেয়ে না, মহীউদ্দীন সাহেবের কাছে সেদিন রাত্রে অমল ঘোষের কাহিনী শুনে মুগ্ধ হয়ে যাই।
প্রায় বিশ বছর আগেকার কথা। তখন পাকিস্তানের একচ্ছত্র অধিপতি ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের তিনি প্রায় ক্রীতদাসই মনে করেন। মাঝে মাঝে কিছু মানুষ গর্জে উঠলেও কোটি কোটি বাঙালী ভয়ে, আতঙ্কে দিন কাটান। অন্যদিকে ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদগার চলছে পুরোদমে। সীমান্তে কড়া নজর। বেনাপোল সীমান্তের ওপর আবার বিশেষ কড়া নজর। হাজার হোক কলকাতার খুব কাছে তো! চেকপোস্টের ও-সি বাঙালী হলেও কাস্টমস-এর সুপারিনটেনডেন্ট ছাড়াও পাঁচ-ছজন ইন্সপেক্টর পাঞ্জাব বা ফ্রন্টিয়ারের লোক। তাছাড়া যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দীন খান কখন যে নেকড়ে বাঘের মত সীমান্তের বাঙালী অফিসার ও সাধারণ কর্মীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে, তা কেউ জানে না। মানুষ যে এত হিংস্র ও অসভ্য হয়, তা ঐ ছোকরা ক্যাপ্টেনকে দেখার আগে বেনাপোল সীমান্তের বাঙালী অফিসার ও কর্মীরা জানতেন না।
সন্ধ্যে ঘুরে গেলেও চেকপোস্টের ওসি ইসলাম সাহেব নিজের ঘরে বসে কাজ করছিলেন। হঠাৎ একটি কনস্টেবল সেলাম করে ওর সামনে দাঁড়াতেই উনি মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, কী, কিছু বলবে?
–স্যার, একটা বারো-তেরো বছরের ছেলে একটা গাছতলায় বসে সারাদিন কাঁদছে।
একটু বিরক্ত হয়েই ইসলাম বললেন, কাঁদছে তা আমি কি করব?
কনস্টেবলটি অপরাধীর মত গলার স্বর বেশ নীচু করেই বলল, ছেলেটা বোধহয় খুব দুঃখী স্যার!
ইসলাম সাহেব হাতের কলমটা নামিয়ে রেখে কী যেন ভাবলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ওর সঙ্গে আর কে আছে?
–আর কেউ নেই স্যার।
–বাড়ি কোথায়?
–স্যার, ছেলেটা শুধু কাঁদছে। কোন কথা বলছে না। তবে চেহারা দেখে মনে হয়, অনেক দূর থেকে হেঁটে এসেছে।
ইসলাম সাহেব আবার কি যেন ভাবেন। তারপর জিজ্ঞেস করেন, ছেলেটি হিন্দু না মুসলমান?
–তাও বুঝতে পারছি না স্যার।
ওসি সাহেব একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা একটা টান দিয়ে বললেন, যাও, ছেলেটাকে নিয়ে এসো।
কনস্টেবল ছেলেটিকে নিয়ে ওসি সাহেবের ঘরে ঢুকতেই উনি একবার ওর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন। তারপর ওকে একটু কাছে ডেকে বললেন, কী নাম তোমার?
শ্ৰীঅমল ঘোষ।
–বাড়ি কোথায়?
-ফরিদপুর।
-ফরিদপুরে কোথায়?
মাদারিপুর।
-মাদারিপুর শহরেই?
-হ্যাঁ।
-তা তুমি সারাদিন ধরে কাঁদছ কেন?
অমল বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারে না। চাপা কান্নায় গলা দিয়ে স্বর বেরুতে পারে না।
ওসি সাহেব আদর করে ওর পিঠে হাত দিতেই অমল উঃ, বলে প্রায় ছিটকে সরে দাঁড়ায়। ইসলাম সাহেব অভিজ্ঞ পুলিস অফিসার। উনি সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলেন, তোমার পিঠে কী ব্যথা?
অমল কাঁদতে কাঁদতেই মুখ নীচু করে শুধু মাথা নেড়ে জানায়, হ্যাঁ।
এতক্ষণ পর ওসি সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে এগিয়ে যান। কোন কথা না বলে অমলের গায়ের জামা তুলে দেখেই চমকে ওঠেন। জিজ্ঞেস করেন, কে তোমাকে এভাবে মেরেছেন?
অমল আগের মতই মুখ নীচু করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমার বাবা আর তার বউ।
ওর কথা শুনে ওসি সাহেব না হেসে পারেন না। বলেন, তোমায় বাবার বউ তোমার কে হন?
আমার কেউ না।
ওসি সাহেব হাসতে হাসতেই জিজ্ঞেস করেন, উনি তোমার মা না?
-না, আমার মা অনেক দিন আগেই মারা গিয়েছেন।
ইসলাম সাহেবের কাছে অমলের দুঃখের দিনের ছবিটা আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যায়। উনি ওকে আর কোন প্রশ্ন না করে কনস্টেবলকে বলেন, তুমি একে আমার কোয়ার্টারে দিয়ে বলে দিও, ও থাকবে।
.
বিমাতা ও স্ত্রৈণ পিতার অকথ্য অত্যাচারের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য অমল একদিন গভীর রাত্তিরে নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে ও সীমাহীন অন্ধকারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, আমাকে বাঁচতে হবে, মানুষের মত বাঁচতে হবে।
কত নদী-নালা অরণ্য-জনপদ পার হয়ে চলতে চলতে অমল স্বপ্ন দেখে, সে কলকাতায় যাবে, লেখাপড়া শিখবে, মানুষ হবে। আর? আর হাজার-হাজার লাখ-লাখ টাকা আয় করে সব গরীব ছেলে মেয়েদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করবে।
ঐ স্বপ্নের ঘোরেই অমল অনাহার, অনিদ্রা ও শরীরের সমস্ত ব্যথা বেদনা ভুলে এগিয়ে চলেছিল। যশোর শহর পার হবার পর একটা চাপা আনন্দে খুশিতে ওর মন ভরে গেল। ভাবল, কলকাতা তো আর বেশী দূর নয়, বড়জোর দুআড়াই দিনের পথ। কিন্তু ঝিকড়গাছা পার হয়ে গদখালি-নাভারণ আসতেই রাস্তার ধারে ই. পি, আরদের দেখে একটু ভয় পায়। ঘাবড়ে যায়। মনে মনে ভয় হয়, ওরা ধরবে না তো? তবু দুটো পা থেমে থাকে না, এগিয়ে চলে।
ওসি সাহেবের কোয়ার্টারে বেশ কয়েক দিন কাটাবার পর অমল একদিন অতি কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে ইসলাম সাহেবকে বলে, স্যার, আপনার দয়ায় আমি বেঁচে গেলাম কিন্তু আমাকে একটা ভিক্ষা দিতে হবে।
-কী চাই তোমার?
–স্যার, আমাকে সীমান্ত পার করে দিতে হবে।
–তোমার পাসপোর্ট-ভিসা আছে?
-না স্যার।
-তবে? তবে কী করে তোমাকে পার করে দেব?
অমল কোন জবাব দেয় না; মুখ নীচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
কয়েক মিনিট নীরব থাকার পর ইসলাম সাহেব বলেন, আমি কী ইচ্ছে করলেই তোমাকে পার করে দিতে পারি? কোন পাঞ্জাবী অফিসার জানতে পারলে হয়ত আমাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গুলি করেই মারবে।