দুএক মিনিট নীরব থাকার পর উনি বললেন, জীবনে আপনি অনেক দুঃখ পেয়েছেন, তাই না?
-দুঃখ? হ্যাঁ, পেয়েছি বৈকি কিন্তু মাঝে মাঝে এত আনন্দ, এত সুখ পেয়েছি যে সত্যি অভাবনীয়। আমি একটু হেসে ওর দিকে তাকিয়ে শাহীর লুধিয়ানভীর একটা শের-এর দুটো লাইন বলি
রাত যিতনী ভী সংগীন হোগী
সুবহ উৎনি হী রংগীন হোগী;
একটু হেসে বলি, আমার জীবনে অমাবস্যা-পূর্ণিমার মত সংগীন রাত আর রংগীন সুবহ বার বার ঘুরে এসেছে।
***
রাত্রে ট্রেনে চড়িয়ে দেবার সময় জয়ন্তী বললেন, আমি নিশ্চয়ই সাত তারিখে বর্ডার পার হবো। আপনি সাত তারিখে ওখানে থাকলে খুব খুশি হবো।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, বান্দা, সাত তারিখেই বর্ডারে পৌঁছবে।
ঐ মাঝ রাত্তিরে যশোর স্টেশনের আবছা আলোতেও স্পষ্ট দেখলাম, আনন্দে খুশিতে জয়ন্তীর মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
৫-৬. পাঁচ তারিখের মধ্যেই
পাঁচ তারিখের মধ্যেই আমার কাজকর্ম শেষ হলেও মহিলা সমিতির মঞ্চে নতুন এক নাট্যগোষ্ঠীর নাটক দেখার জন্য ছ তারিখ ঢাকায় রইলাম। সাত তারিখের সেকেণ্ড ফ্লাইটে যশোর হয়ে যখন বেনাপোল সীমান্তে পৌঁছলাম, তখন বেলা গড়িয়ে গেছে।
হাতের সুটকেসটা নিয়ে চেকপোস্টের ওসি মহীউদ্দীন সাহেবের ঘরে ঢুকে দেখি, উনি নেই। ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় পা দিতেই একজন কনস্টেবল আমাকে সেলাম দিয়ে বললেন, ঘোষ সাহেব এসেছেন বলে ওসি সাহেব কাস্টমস সুপারিনটেনডেন্ট সাহেবের ওখানে গিয়েছেন।
মনে হলো, কনস্টেবলটি যাবার দিন নিশ্চয়ই আমাকে দেখেছিলেন। তাই ওকে জিজ্ঞেস করলাম, কে ঘোষ সাহেব?
আমার প্রশ্ন শুনে উনি যেন অবাকই হলেন। বললেন, আপনি ঘোষ সাহেবকে চেনেন না? ওকে তো কলকাতার সবাই চেনেন।…
-আমি তো কলকাতায় থাকি না।
–ও! আমার অজ্ঞানতার কারণে উনি বোধহয় সন্তুষ্ট হলেন। বললেন, ঘোষ সাহেব কোটি কোটি টাকার মালিক। আমাদের দেশেরই মানুষ। প্রায়ই যাতায়াত করেন।
ও!
মহীউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য কাস্টমস বিল্ডি-এর দিকে যেতে যেতে ভাবি, পয়সা থাকলেই কী সর্বত্র খাতির পাওয়া যায়? নাকি অর্থ দেখলেই মানুষ গোলাম হতে চায়?
মনে মনে একটু বিরক্ত হয়েই কাস্টমস বিল্ডিং-এ ঢুকি। বারান্দা পার হয়ে মালপত্র তল্লাসীর হলঘরে পা দিয়েই দেখি, কাউন্টারের একদিকে এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোককে ঘিরে এপার-ওপার দুদিকের কাস্টমস-ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের অনেকেই হাসি-ঠাট্টায় মত্ত। আমি বুঝলাম, ঐ মধ্যবয়সী ভদ্রলোকই কোটিপতি মিঃ ঘোষ।
আমি আর এগুলাম না। বারান্দায় এসে একটা সিগারেট ধরালাম। ঘোষ সাহেবকে নিয়ে কখন আড্ডা শুরু হয়েছে আর কখন শেষ হবে, তা ভেবে না পেয়ে সিগারেট শেষ হবার পর নীচে নেমে এসে একটা ডাব খেলাম। তারপর একটু পায়চারি করতে করতেই দেখি, ঘোষ সাহেব সদলবলে বেরিয়ে এলেন। আমি তাড়াতাড়ি একটু দূরে সরে গেলাম।
দূর থেকে দেখলাম, পুলিস কাস্টমস-এর লোকজন ঘোষ সাহেবের মালপত্র গাড়িতে তুলল। তারপর উনি কাস্টমস সুপারিনটেনডেন্ট রহমান সাহেব ও মহীউদ্দীন সাহেব থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি কনস্টেবলকে পর্যন্ত বুকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিলেন। মনে মনে ভাবি, লোকটি নিশ্চয়ই স্মাগলার! তা নয়ত এদের সবার সঙ্গে এত খাতির ভালবাসা কেন?
মিঃ ঘোষের গাড়ি ছাড়ার পর আমি কয়েক পা এগুতেই মহীউদ্দীন সাহেব আমাকে দেখে প্রায় দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলেন, আপনি কখন এলেন?
-এখনও আধঘণ্টা হয় নি।
-সে কী? উনি অবাক হয়ে বললেন, আমাকে ডাকেন নি কেন? ছি, ছি, এতক্ষণ আপনি..
না, না, আমার কিছু কষ্ট হয় নি। দেখলাম, আপনারা গল্প করছেন, তাই আর বিরক্ত করলাম না।
উনি মাথা নেড়ে বললেন, আপনি ডাকলে বিরক্ত হতাম, কী যে বলেন। সঙ্গে সঙ্গে উনি আক্ষেপ করে বললেন, তাছাড়া অমলের সঙ্গে আলাপ হলে আপনিও খুশি হতেন।
–কে অমল।
–অমল ঘোষ। এই তো যার সঙ্গে আমরা সবাই গান করছিলাম।
মনে মনে বলি, পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ অমল ঘোষ আছে কিন্তু তাদের সঙ্গে পরিচিত হতে আমি একটুও আগ্রহী নই। তাছাড়া কোটিপতিকে আমার কী প্রয়োজন? আমি তো তাদের খাতির বা গোলামি করতে পারব না। যাই হোক, আমি শুধু বললাম, ব্যস্ত কী? হয়ত ভবিষ্যতে কোনদিন আলাপ হবে।
মহীউদ্দীন সাহেব আমাকে নিয়ে ওর অফিস ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন, তা হয়ত হবে কিন্তু অমলের মত হীরের টুকরো ছেলের সঙ্গে যত আলাপ হয়, ততই ভাল।
আমি ওর কথা শুনে একটু অবাক হলেও কোন কথা বলি না।
মহীউদ্দীন সাহেব আমাকে সাদরে নিজের ঘরে বসিয়েই একজন কনস্টেবলকে দৌড়ে ডাব আনতে হুকুম দিয়েই আমাকে বললেন, আপনার বন্ধু আসার আগেই বলে রাখি আজ রাত্তিরে আপনি আমার ওখানেই দুটো মাছের ঝোল ভাত খাবেন।
আমি হেসে বলি, ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আমি তো দু একদিন আছি। পরে…
-না, না, পরে-টরে না। আজ রাত্তিরে আমার সঙ্গে মাছের ঝোল ভাত খেয়ে তবে ইণ্ডিয়ায় ঢুকবেন।
আমি ডাব খেয়ে সিগারেট ধরাতে না ধরাতেই নিত্য ও আরো কয়েকজন হাজির হলো। মহীউদ্দীন সাহেব হাসতে হাসতে নিত্যকে বললেন, বাচ্চুবাবু আজ ইণ্ডিয়ায় যাবেন কিনা সন্দেহ।
বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব হাসাহাসির পর আমি নিত্যর সঙ্গে এবারে কাস্টমস কলোনীর গেস্ট হাউসে গেলাম। নিত্য ও কাস্টমস এর কিছু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে আমি আবার সীমান্ত অতিক্রম করে ওপারে যাই।