রোজ বিকেলের দিকে দুতিনটে লরি এসে দত্ত বাড়ির ইট, দরজা-জানলা,কড়ি-বরগা আর পাথর নিয়ে চলে যায়। একদল মেয়ে-পুরুষ ছেলে-ছোকরা হাঁ করে এইসব দেখে। দেখে মুকুন্দর দোকানের খদ্দেররাও। পঞ্চু মিস্ত্রি চা খেতে খেতে বলে, জামিস মুকুন্দ, আমাদের পুব্বোপুরুষ বলাগড় ছেড়ে চলে আসে শুধু এই দত্তবাবুদের বড়ির কাজে করার জন্যি।
মুকুন্দ অন্য খদ্দেরদের চা তৈরি করতে করতেই জিজ্ঞেস করে, দত্তবাবুদের আদি বাড়ি ছিল কাটোয়ায়, তাই না?
পঞ্চু মিস্ত্রি একটা ছোট্ট চ্যাপ্টা ওষুধের কৌটো থেকে বিড়ি বের করতে করতে একটু হেসে বলে, দত্তবাবুরা আসলে অয়োরদীপের লোক; ঐ কাটোয়ার পাশেই আর কি!
মুকুন্দও এই ভবানীপুরেরই ছেলে। এইখানেই ছিল ওর পূর্ব-পুরুষের বাস। গাঁজা পার্কের পাশের রাস্তায় যেখানে ব্রাহ্মরা উপাসনা করতেন, তার কাছেই ছিল বামনদাস ঘোষের বিরাট দোতলা বড়ি। ক্লাইভ স্ট্রিট-ক্যানিং স্ট্রিটের মোড়ের কাছেই ছিল বামনদাস ঘোষের লোহা-লক্কড়ের দোকান।
বামনদাস যেমন কর্মবীর ছিলেন, তেমনই ধার্মিক ও বিনয়ী ছিলেন। শীত-গ্রীষ্ম বারো মাস তিনশ পয়ষট্টি দিন ভোরবেলায় গঙ্গাস্নান করে বাড়ি ফিরেই গীতার এক অধ্যায় পাঠ না করে উনি জলগ্রহণ করতেন না। ব্রাহ্মণদের কি ভক্তিই করতেন! ভ্যাবলা বসিরহাটের রাজেন মুখুজ্যে ওঁর বাল্যবন্ধু ছিলেন এবং এঁরই অনুপ্রেরণায় বামনদাস গ্রাম ছেড়ে কলকাতা এসে চিৎপুরের একটা দোকানে তিন টাকা মাইনের কর্মচারী হন। পরবর্তী জীবনে বামনদাস ওঁর ছেলেমেয়েদের বলতেন, ওরে, মার্টিনবার্নের মালিক হয়েছে বলে এখন আমাদের ভ্যাবলার রাজেনকে নিয়ে সবাই নাচানাচি করে। শেরিফ আর স্যার উপাধি পাবার পর তো ইংরেজি খবরের কাগজেও ওর ছবি ছাপা হচ্ছে কিন্তু লোকে তো জানে না অভাবের জন্য ছেলেটাকে এঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে দিতে হয়েছিল।
ছেলেমেয়েরা এ গল্প বহুবার শুনেছে। আবার শুনতে ভালও লাগে না কিন্তু তবু চুপ করে বাবার কথা শোনে।
রাজেন তখন ঠিকাদারী করে। একদিন আমাকে বলল, বামন, তোমাকে ব্যবসা বাণিজ্য করতে হবে এবং তার জন্য অভিজ্ঞতা চাই। তাই তো আমি চিৎপুরের দত্ত কোম্পানির তিন টাকা মাইনের চাকরি নিলাম।
বামনদাস একবার বুকভরা নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, হাজার হোক বামুনের ঘরের ছেলের রাজেনের কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল।
এই স্যার আর. এন. মুখার্জির উৎসাহে ও পরামর্শে বামনদাসও ব্যবসা-বাণিজ্য করে রীতিমত ধনী হন কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তাঁরই ছোট নাতি মুকুন্দ এখন চায়ের দোকান চালিয়ে কোনোমতে সংসার চালাচ্ছে। তা হোক। কিন্তু ও ছোটবেলায় কয়েকটা বছর বাড়িতে ম্যানেজারবাবু না দেখলেও বাজার সরকার দেখেছে, একটা লম্বা মোটরগাড়ি দেখেছে। বাড়িতে দুর্গাপূজা হবার কথাও একটু একটু মনে পড়ে। সে যাই হোক, মুকুন্দর স্পষ্ট মনে আছে, বাজার সরকার শ্রীহরিবার থেকে শুরু করে ঝি-চাকরদেরও বাড়ি ছিল। বসিরহাটে। ভবানীপুরের লোকজন তো ওদের বাড়ির নামই দিয়েছিল বসিরহাটি ঘোষের বাড়ি। তাই পঞ্চু মিস্ত্রির কথা শুনে ও অবাক হয় না।
পঞ্চু বিড়ি ধরিয়ে একটা টান দিয়ে বলে, ঠাকুমার কাছে শুনেছি, এই দত্তবাড়ি তৈরি হবার সময় এক কর্তা শুধু পছন্দমতো কাঠ কেনার জন্য জাহাজে চড়ে বার্মা মুল্লুকে চলে গিয়েছিলেন। আরেক কর্তা পাথর কেনার জন্য গেলেন উত্তর না পুবে।
ওর পিছন দিক থেকে কার্তিক বলে, তখনকার দিনের কর্তাদের ব্যাপারই ছিল আলাদা।
-সত্যিই তাই। পঞ্চু খুব জোরে বিড়িতে শেষ টান দিয়ে বলে, ঐ ঠাকুমার কাছেই শুনেছি, দত্তবাড়ির বউরা দুগ্নপূজার সময় রোজ এক একখানা নতুন বেনারসী পরতেন।
মুকুন্দ কথাটা শুনে আপনমনেই হাসে।
পঞ্চু একটু থেমে আবার বলে, তবে হ্যাঁ, মিথ্যে কথা বলব না। দত্তবাড়ির কর্তাবাবুরা আমাদের মতো দেশের লোকজনকেও যথেষ্ট দেখাশুনো করতেন। ঐ বাড়ির খেয়েপরেই তো বাপ-ঠাকুদ্দার সংসার চলেছে।
.
দুপুরবেলার দিকে বুড়ি কামিনীবালা মুকুন্দকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, হারে নাতি, দত্তদের বাড়িটা নাকি ভাঙছে?
-হ্যাঁ, ঠাকুমা।
–ঐ বিনু হতচ্ছাড়াটা তো সত্যি কথা বলতে শেখেনি, তাই শুনে ভাবলাম তোকে জিজ্ঞেস করলে খাঁটি খবরটা জানা যাবে।
–হ্যাঁ ঠাকুমা; ওরা পুরোনো বাড়িটা ভেঙে ওখানে নতুন করে বড় বাড়ি তৈরি করবে।
কামিনীবালা অবাক হয়ে বলেন, অমন সুন্দর বাড়িটা ভাঙারই বা কী দরকার আবার নতুন করে তৈরিই বা করবি কেন?
মুকুন্দ বলে, ঠাকুমা, আজকাল তো ঐ ধরনের বাড়ি কেউ তৈরি করে না, নতুন ধরনের….
ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বুড়ী দুহাতের দুটো বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলেন, আজকালকার লোকদের মুরোদ থাকলে তো ঐ ধরনের বাড়ি বানাবে!
মুকুন্দ এন্টু হেসে বুড়িকে সমর্থন জানায়।
-বুঝলি নাতি, ঠাকুরের কাছে শুনেছি, আমাদের এই বাড়ি আর দত্তদের বাড়ি একই বিলেত-ফেরত ইঞ্জিন-ইয়ার বানায়। এই দুই বাড়ির জানলা-দরজা কড়ি-বরগার কাঠ কেনার জন্য ঐ বাড়ির এক কর্তা জাহাজে করে বার্মা দেশে যান, আর পাথরটাথর কেনার জন্য এই বাড়ির এক জামাইকে বিলেতে পাঠানো হয়।
–দুই বাড়ির তো দারুণ ভাব ছিল!
বুড়ি চোখ দুটো বড় বড় করে বলেন, ভাব ছিল মানে — দারুণ ভাব। উনি এক থেমে বলেন, ঠাকুরের কাছেই শুনেছি..