–আঃ! কীর্তন-টির্তন বন্ধ করো। আমি ভিক্ষে দিই না। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে সতীশ সরকার এই কথা বলে ডান হাত নেড়ে চলে যেতে বলেন।
বাবু, এমন দিনেও একটা পয়সা ভিক্ষে দেবেন না?
সতীশ সরকার অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলেন, বলছি চলে যাও।
ব্যস! এক পলকের মধ্যে দুটি বৈষ্ণবের হাতে দুটি পিস্তল একসঙ্গে পরপর কয়েক বার গর্জে উঠল!
গুলির আওয়াজ শুনে রেলের বাবুরা যখন প্ল্যাটফর্মে এসে হাজির হলেন, তখন শুধু সূতীশ দারোগার মৃতদেহ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীকে আশেপাশে কোথাও দেখতে পেলেন না। হীরেন বেরা ও নগেন সামন্ত পরে প্রেপ্তার হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু সে অন্য মামলায়।
এই বেইমান সর্বজনঘৃণ্য সতীশ দারোগার একমাত্র পুত্র যতীন সরকার।
.
বন্ধুর বউ-এর কথাবার্তা শুনলে এইসব ও আরো কত কি মনে পড়ে বৃদ্ধ অমূল্যচরণের।
ওঁরা তিন ভাই ছিলেন কিন্তু ছোট ভাই খুব অল্প বয়সেই মারা যান। বড় ভাই প্রফুল্লচরণের একমাত্র সন্তান এই বন্ধু। অমূল্যচরণের দুই মেয়ে কিন্তু কোনো ছেলে নেই বলে বন্ধুকেই নিজের পুত্রতুল্য স্নেহ-ভালবাসা দিয়ে বড় করেছেন। বন্ধুর যত দোষই। থাক, মেজকাকা বা কাকিমাকে কোনোদিনই কোনো অপমানজনক ব্যবহার করে না এবং করবেও না। কিন্তু বেচারীর কোনো ব্যক্তিত্ব নেই বলে স্ত্রীর কথায় ওঠে-বসে। উমারানী মেজকাকাকে যত অপমানই করুক, তাকে একটি কথা বলারও সাহস নেই বন্ধুর।
তবে অমূল্যচরণের স্ত্রী উমারানীর বেয়াদপি একদম বরদাস্ত করেন না। উনি স্পষ্ট বলে দেন, বৌমা, ভুলে যেও না বন্ধু শুধু তোমার স্বামী না, সে আমাদেরও ছেলে। শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে কী করে কথা বলতে হয়, তাও কি বাবা-মা শেখাননি?
উমারানীও যুদ্ধ না করে পরাজয় বরণ করার পাত্রী না। উনি রান্না করতে করতেই জবাব দেন, ভুলে যাবেন না আমি উলুবেড়ে লাটবাড়ির মেয়ে। আপনাদের মতো জংলিদের সঙ্গে কী করে কথা বলতে হয় তা সত্যি শিখিনি।
–বৌমা, আর হাসিও না। এমন বিখ্যাত বাড়িরই মেয়ে তুমি যে ঘেন্নায় কোনো আত্নীয়-স্বজন বন্ধুর বিয়েতে বরযাত্রী গেলেন না।
-তাতে আমাদের বয়েই গেছে।
–এত অহঙ্কার বা মেজাজ কোনোটাই যে ভাল না, তা কি এখনও বুঝতে পারছো না? বাপ আর মেয়েতে মিলে এই সোনার সংসারটা ছারখার করে দিলে!
একটু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুকুন্দর চায়ের দোকালে এক দল ছেলেছোকরার আড্ডা জমে উঠেছে। হঠাৎনন্দু দোকানে ঢুকতেই পটল জিজ্ঞেস করল, কিরে চাঁদুকাল সন্ধেবেলায় কোথায় ডুব দিয়েছিলি?
ঘোড়ায় চড়ার মতো বেঞ্চির দুপাশে পা দিয়ে বসে নন্দু ভুরু নাচিয়ে বলল, মাইরি, রেখা আমাকে পাগল করে দেবে। আর অমিতাভ শালা কি অ্যাকটিংই করেছে মাইরি!
কচি মুখ টিপে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল, ম্যাটিনি দেখে কী তোরা ইডেন গার্ডেনে আড্ডা দিলি?
–তোরা মানে? নন্দুও একটু মুখ টিপে হেসে বলল, তাছাড়া ম্যাটিনিতে গিয়েছি। তোকে কে বলল?
তুই বেড়াস ডালে ডালে, আমি বেড়াই পাতায় পাতায়। কচি একটু থেমে বলল, পৌনে দুটোর সময় ল্যান্সডাউন মার্কেটের ওখানে তোর কারেন্ট হিরোইনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই…
পটল হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, ক্যাকটুকট! মুকুন্দদা, নন্দুর অ্যাকাউন্টে তিনটে ডবল ওমলেট আর তিনটে ডবল-হাফ চা!
–ডবল ডিমের ওমলেট না চিকেন কাটলেট খাওয়াবো! মুকুন্দদা, তিনটে ডবল হাফ চা দাও!
মুকুন্দ এক মিনিটের মধ্যে তিনটে চা ওদের সামনে দিয়ে বলে, আচ্ছা, তোরা কি এইভাবে চ্যাংড়ামি ফাজলামি করেই জীবন কাটিয়ে দিতে পারবি?
পটল দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলল, জয় মা পাতালরেল!
মুকুন্দ ওর কাণ্ড দেখে একটু না হেসে পারে না।
কচি বলল, দ্যাখো মুকুন্দদা, তুমি আর ভবানীপুর থানার লোকজন আমাদের রিয়েল ফ্রেন্ড! তোমাকে খেলাখুলি বলছি, যতদিন পাতালরেলের পুরোটা পাতালে চালু না হবে আর চন্দনদা আছে, ততদিন..:
–ওরে, চোরের দশ দিন, গেরস্থর একদিন! সেদিন কি করবি?
নন্দু চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে বলল, রামকেষ্ট-বিবেকানন্দ যা পারেনি, আমরা তাই পেরেছি। হোল বাঙালি জাতিটা ধম্মোকে ভুলে গিয়েছিল কিন্তু এই আমরাই আবার বাঙালির ধম্মা ভাব জাগিয়ে তুলেছি।
পেটল বলল, ঠিক বলেছিস! ও মুকুন্দর দিকে তাকিয়ে বলে, আগে বাঙালি দুর্গাপূজা আর কালীপূজা ছাড়া কোন পূজা করতো?
সঙ্গে সঙ্গে কচি বলল, আর স্কুল কলেজে সরস্বতী পূজা!
নন্দু একটু গম্ভীর হয়ে বলে, গুপ্তপ্রেস পাঁজিতে যত রকমের পূজার কথা আছে, সব রকম পূজা হচ্ছে শুধু আমাদেরই জন্য। এবার নন্দু একটু হেসে বলে, তুমি তো ভাল করেই জানো মুকুন্দদা, শনিঠাকুরের কৃপাতেই আমরা হেসেখেলে সপ্তাহের চার-পাঁচটে দিন কাটিয়ে দিতে পারি। আর শনিবার অমাবস্যা হলে তো পুরো মাসটাই ঠাকুরের কৃপায় কেটে যায়।
মুকুন্দ কাপ-ডিশ ধুতে ধুতেই বলে, তোদের কেলোর কীর্তি সব জানি। আমাকে আর নতুন করে বলতে হবে না। একটু নিঃশ্বাস নিয়ে ও যেন আপন মনেই বলে, তোরা কোন সব ফ্যামিলির ছেলে আর কি করে জীবন কাটাচ্ছিস!
কচি দপ করে জ্বলে ওঠে, রেখে দাও ফ্যামিলির কথা! সব ফ্যামিলির কীর্তিই আমাদের জানা আছে।
.
০২.
দত্তদের বাড়িটা সত্যি সত্যি ভাঙা শুরু হয়েছে। প্রায় শখানেক কুলি-মজুর বিরাট হাতুড়ি পিটিয়ে ভাঙছে আর ইট-কাঠ-পাথর সাজিয়ে রাখছে। চার-পাঁচজন বাবু গোছর লোক ওদের কাজ-কর্ম তদারক করছেন। কখনও কখনও মোটর হাঁকিয়ে এঞ্জিনিয়ার সাহেব মিঃ ঘোষ ঐসব বাবুদের কি সব বুঝিয়ে যাচ্ছেন। কোনদিন বিকেলের দিকে দুধের মতো সাদা ধবধবে মোটর চড়ে স্বয়ং কিশোর আগরওয়াল এসে বেশ কিছুক্ষণ সময় এখানে কাটান। দুপাঁচ দিন পরপর বৃদ্ধ কেশব আগরওয়ালও একবার চক্কর দিয়ে যান।