উনি একটু থেমে বলেন, আমাদের গুদামে কী কোনো কাপড়-চোপড় আছে?
না।
আমরা সব পেমেন্ট পেয়েছি?
না; বাজারে পঞ্চাশ-ষাট হাজারের মত পাওনা আছে।
রেল থেকে নতুন অর্ডার এসেছে কি?
না।
রেলের কাছে আমাদের কত পাওনা?
তা ন -দশ লাখ হবে।
সে টাকা কবে নাগাদ পাওয়া যাবে?
সামনের মার্চের মধ্যে নিশ্চয়ই সব পেমেন্ট এসে যাবে।
কোন ব্যাঙ্কে কত আছে আর কোথায় কি দেবার বা পাবার আছে, তার একটা পুরো হিসেব আমাকে দেবেন তো!
হ্যাঁ, দুএকদিনের মধ্যেই দিয়ে দেব।
.
ঐ হিসেব-নিকেশ পাবার দুচারদিন পরই নরোত্তম ভটচাজমশাইকে বললেন, পুরো টাকাটা ছভাগ হবে। আমি, আমার দুই স্ত্রী আর তিন ছেলের নামে সমানভাবে ভাগ করে ছটা আলাদা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে।
ভটচাজমশাই মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, খুলে দেব।
কলকাতার কোন একটা সম্পত্তি বিক্রি করে আমি কাশীতে আর পুরীতে দুটো বাড়ি কিনতে চাই কিন্তু কোন সম্পত্তিটা বিক্রি করা ঠিক হবে, তা একটু ভেবেচিন্তে আমাকে বলবেন।
তুমি কি এখান থেকে চলে যেতে চাও?
পুরোপুরি না গেলেও বারো মাস এখানে পড়ে থাকতে চাই না।
নরোত্তম একটু থেমে বললেন, উকিলবাবুকে একটু দেখা করতে বলবেন।
হ্যাঁ, বলব।
দিনের পর দিন উকিলবাবুর সঙ্গে শলা-পরামর্শ করে উইলের খসড়া তৈরি হবার পর নরোত্তম হাইকোর্টের প্রবীণ ব্যারিস্টার নগেন রায়চৌধুরীকে বললেন, উইলটা যদি একটু দেখে দেন, তাহলে খুব ভাল হয়।
আপনি রবিবার সকালে এলেই আমি আমার মতামত জানিয়ে দেব।
রবিবার সকালে নরোত্তম ব্যারিস্টার সাহেবের চেম্বারে ঢুকতেই অমর রায়চৌধুরী হাসতে হাসতে বললেন, মল্লিকমশাই, দারুণ উইল করেছেন। আপনার ছেলেরা তো দূরের কথা, নাতিরাও এইসব সম্পত্তি নষ্ট করতে পারবে না। আর বসতবাড়িটা দেবোত্তর করে খুব বুদ্ধিমানের মত কাজ করেছেন।
এবার উনি হাসতে হাসতে বললেন, ব্যারিস্টারি করতে গিয়ে দেখছি, বাঙালি কেরামদের প্রায় সব ছেলেরাই বেচারাম হয় কিন্তু আপনার ছেলেদের সে দুর্নাম হবার রাস্তা আপনিই বন্ধ করে গেলেন।
উইল-পর্ব মেটার পর ভটচাজমশাই বললেন, নরোত্তম, এবার কি আমার ছুটি?
না, আরো একটা জরুরি কাজ আপনাকে করতে হবে।
আবার কী কাজ?
নরোত্তম একটু চাপা হাসি হেসে বলে, শুধু আপনি না, আমার দুই স্ত্রী ছাড়া মেয়ে জামাইও করুণাকে অত্যন্ত পছন্দ করেন।
ভটচাজমশাই এক গাল হাসি হেসে বলেন, পছন্দ তো দুরের কথা, ওকে আমি ঠিক মায়ের মত শ্রদ্ধা করি, ভালবাসি।
করুণা যদি বিধবা না হতো, তাহলে কি সুবলের সঙ্গে ওর বিয়ে হতে পারত?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
কিন্তু করুণা যে সম্পর্কে ওর মাসি হয়?
করুণার সঙ্গে তো ছোট মার প্রত্যক্ষ কোনো সম্পর্ক নেই।
হ্যাঁ, তা ঠিক।
এবার নরোত্তম একে প্রশ্ন করেন, সুবল যদি আপনার ছেলে হতো, তাহলে কি এই বিধবা করুণার সঙ্গে তার বিয়ে দিতে পারতেন?
ভটচাজমশাই আবার এক গাল হাসি হেসে বলেন, করুণা আমার পুত্রবধু হলে আমি আবার প্রাণভরে মা বলে ডাকতে পারতাম।
যদি আমার দুই স্ত্রীর মত আদায় করতে পারেন, তাহলে আপনি সুবলের সঙ্গে করুণার বিয়ের ব্যবস্থা করুন।
ওরা দুজনে তো অনেক দিন ধরেই এই বিয়ের কথা আমাকে বলছে কিন্তু সাহস করে……..
তাহলে আর কি! এবার উঠে-পড়ে লেগে যান।
.
কী ব্যাপার মল্লিকমশাই? হঠাৎ এতদিন পর…
সাবিত্রীর বিস্ময়মিশ্রিত কৌতুকে নরোত্তম কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ না করে শুধু বললেন, ঘরে চল। তোর সঙ্গে জরুরি কথা আছে।
ঘরের মধ্যে পা দিয়েই সাবিত্রী নরোত্তমের দুটো হাত ধরে প্রশ্ন করে, আগে বল, তুমি কেমন আছে। এর মধ্যে শরীর খারাপ হয়নি তো?
আমি ভালই আছি।
বড় বউ, ছোট বউ আর ছেলেমেয়েরা?
ওরাও ভাল আছে।
করুণা কেমন আছে? ও তোমাদের কাছেই আছে তো?
নরোত্তম একটু হেসে বলেন, করুণা খুব ভাল আছে।
সাবিত্রী একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, খুব ভাল আছে মানে?
সুবলের সঙ্গে করুণার বিয়ে দিয়েছি।
আনন্দে-খুশিতে উত্তেজিত হয়ে সাবিত্রী এক গাল হেসে বলে, সত্যি সুবলের সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়েছ?
হ্যাঁ।
খুব ভাল কাজ করেছ মল্পিকমশাই।
সাবিত্রী উদাস দৃষ্টিতে বহু দূরের ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, এ সংসারে মেয়েদের দুঃখ-কষ্ট কেউ বুঝতে চায় না।
এবার ও ঘুরিয়ে নরোত্তমের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে, তুমি যে ঐ হতভাগিনীকে নিজের পুত্রবধূ করেছ, তা জেনে খুব ভাল লাগছে।
নরোত্তম শুধু একটু হাসেন।
সাবিত্রী আবার বলে, বিধবার সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিলে বলে আত্মীয়-স্বজনরা নিশ্চয়ই খুব নিন্দা করেছে?
হ্যাঁ, অনেকেই নিন্দা করেছে, অনেকই আসে নি।
নরোত্তম একটু হেসে বলেন, তুই তো জানিস, আমি নিন্দা বা প্রশংসার পরোয়া করি না। আমি আমার কাজ করে যাই।
তা আর জানি না? খুব ভাল করেই জানি।
সাবিত্রী হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলে, তুমি বসো। আমি তোমার জলখাবার আনি।
না, না, কিছু আনতে হবে না।
নরোত্তম এক গাল হেসে বলেন, আজকাল বৌমা আমাকে এক পেট না খাইয়ে বাড়ি থেকে বেরুতেই দেয় না।
খুব ভাল করেছে।
সাবিত্রী একটু থেমে বলে, এবার বল কি জরুরি কথা বলবে।
হ্যাঁ, বলছি।
নরোত্তম একটু থেমে বলেন, টাকাকড়ি বিষয়-সম্পত্তি তিন ছেলে আর দুই বউকে দিয়ে আমি ছুটি নিলাম।
ছুটি নিলাম মানে?