দুচার মিনিট চুপ করে থাকার পর কণিকা জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা ছোট কাকা, ইংরেজ আমলের সব বাঙালি বড়লোকেদের কী এই রকম অবস্থা হয়েছিল?
না, না, সবার অবস্থা এ রকম হয়নি।
অঘোরনাথ একটু থেমে বলেন, যাদের বিচার বুদ্ধির বা বাস্তব জ্ঞান ছিল, তাদের অবস্থা কখনই দত্তদের বা সরকারদের মত হয়নি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নতুন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেছে বা অন্য কোনভাবে বিষয়-সম্পত্তি রক্ষা করেছে।
.
হঠাৎ সবকিছু বদলে গেল। যারা জেল খাটত, কয়েদ খাটত, নিত্য নৈমিত্তিক পুলিশের লাঠি-গুলি খেত, তারা রাজার গদিতে বসল; আর যারা দেড়শ-দুশ বছর ধরে রাজত্ব করেছে, তারা সবাই নিঃশব্দে জাহাজে চড়ে সমুদ্র পাড়ি দিল। যে লাল পাগড়িওলায়াদের দেখে সাধারণ মানুষের হৃদপিণ্ডের ওঠানামা হঠাৎ থমকে যেতো, সেই লালবাজারের লাল পাগড়িওয়ালারা পর্যন্ত সাধারণ মানুষদের ভক্তি শ্রদ্ধা করতে শুরু করল। হোয়াইটওয়ে লেডল আর হল অ্যান্ড অ্যান্ডারসনের বিক্রি যত কমল, খাদি প্রতিষ্ঠানের বিক্রি ঠিক তত বাড়ল।
আরো, আরো কত কি হল। রোগে-শোকে না, মানুষেরই হাতে মানুষ মরল হাজার হাজার! মানুষের ঘরবাড়িতে মানুষই আগুন দিল। লাখ লাখ মানুষ এদিক থেকে ওদিকে গেল, ওদিক থেকে এগিয়ে এলো। লাখ লাখ মানুষ সর্বস্ব খুইয়ে ভিখিরি হল; আবার ভাগ্যবান ভিখিরির দল খেয়াল খুশিমত ঘরবাড়ি দখল করে নিতেও দ্বিধা করল না। বাস্তুহারা বলে একটা নতুন সম্প্রদায় জন্ম নিল সারা দেশের গ্রামে-গঞ্জে শহরেনগরে।
আরো, আরো কত কি ঘটল। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের দালাল আদর্শহীন মনুষ্যত্বহীন হৃদয়হীন আই-সি-এস আর দালাল অত্যাচারী পুলিশ অফিসারের দল হঠাৎ রাতারাতি দেশবাসীর সেবক ও দেশপ্রেমিক হবার জন্য রীতিমত হাস্যকর প্রতিযোগিতা শুরু করল।
দেশের এইসব অভাবনীয় পরিবর্তনের কথা ভেবে কুলকিনারা পান না নরোত্তম মল্লিক। আপনমনে বিভোর হয়ে আকাশ-পাতাল চিন্তা করেন। ব্যবসা বাণিজ্য বিষয় সম্পত্তির ব্যাপারে কী করা উচিত, তাও বুঝতে পারেন না।
এইসব ভাবনা-চিন্তা করতে করতেই বেশ কয়েক মাস কেটে গেল।
.
সেদিন সকালে উঠেই নরোত্তম ভটচাজমশাইকে ডেকে পাঠালেন।…
ভটচাজমশাই ঘরে ঢুকেই বলেন, আমাকে কি কিছু বলবে?
নরোত্তম একটু হেসে বলেন, শুধু বলব না, কিছু শুনতেও চাই।
ভটচাজমশাই বসতেই নরোত্তম বলেন, দেশের অবস্থা কী রকম মনে হচ্ছে?
নিশ্চয় ভাল না।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, হাজার হোক রাজত্ব বদল হল। রাজত্ব বদল হলেই এই ধরনের অশান্তি বা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চিরকালই ঘটেছে কিন্তু অনন্তকাল ধরে তো এইরকম পরিস্থিতি থাকবে না।
ভটচাজমশাই একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, আমি কখনই বলছি না, দুচার মাসের মধ্যেই সারা দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে যাবে; তবে দুচার বছরের মধ্যে নিশ্চয়ই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
নরোত্তম মাথা নেড়ে বলেন, বোধহয় আপনি ঠিকই বলছেন।
এবার উনি মুখ তুলে ভটচাজমশায়ের দিকে তাকিয়ে বলেন আপনার মতে আমার এখন কী করা উচিত?
আমার মতামত না হয় পরে বলব। তুমি কী ভাবছ, সেটা আগে শুনি।
আমার আর ব্যবসা বাণিজ্য করার ইচ্ছা নেই।
কেন?
প্রথম কথা, আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তাছাড়া যেসব কংগ্রেসিরা গদিতে বসেছে, তারা আমাকে একদমই পছন্দ করে না।
নরোত্তম একটু থেমে বলেন, দেশ স্বাধীন হবার পর যে বিলেতি কাপড়ের আমদানি বা ব্যবসা আর চলতে পারে না, তা আমি জানি কিন্তু সারা দেশে রেল চালাতে হলে এই গভর্নমেন্টকেও বিলেত থেকে কয়েক শকোটি টাকার যন্ত্রপাতি বা পার্টস আমদানী করতেই হবে।
হ্যাঁ, তা তো হবেই।
কিন্তু কংগ্রেস গভর্নমেন্ট কখনই আমাকে ঐ ব্যবসাও করতে দেবে না।
ভটচাজমশাই একটু হেসে বলেন, নরোত্তম, দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে জওহরলাল বা সর্দার প্যাটেল যখন কংগ্রেসিদের থানার দারোগা বা আই-সি-এসদের চেয়ারে বসাননি, তখন তোমার মত ব্যবসাদারদের যে ওরা লাইসেন্স-পা দেবে না, তা মনে করার কোনো কারণ নেই।
উনি সঙ্গে সঙ্গেই বলেন, তবে হ্যাঁ,নতুন পরিস্থিতিতে নতুনভাবে ব্যবসা করতে হবে।
কিন্তু ভটচাজমশাই, এই বয়সে আমি আর নতুন করে কিছু করতে চাই না।
তুমি না পার, সুবল করবে।
ভটচাজমশাই মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, সুবল তোমার মেজ ছেলের মত বি.এ. পাস করে বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে না গেলেও যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছেলে।
নরোত্তম একটু হেসে বলেন, আপনি সুবলকে একটু বেশি ভালবাসেন।
কথাটা ঠিক বললে না। তোমার নিটি ছেলেই অত্যন্ত ভাল। আমি ওদের তিনজনকেই যেমন পছন্দ করি, সেইরকমই স্নেহ করি। ওরাও আমাকে যথেষ্ট সম্মান ও শ্রদ্ধা করে।
উনি একটু থেমে বলেন, তবে বেশ কয়েক বছর ধরে ব্যবসা বাণিজ্যের কাজে সুবলকে যেভাবে কাজ করতে দেখছি, তাতে আমার মনে হয়েছে, ও অত্যন্ত নির্ভরশীল ছেলে।
হ্যাঁ, তা ঠিক কিন্তু অন্য দুছেলে তো ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপারে একদম আগ্রহী না।
তোমার সেজ ছেলে বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে এসে নিশ্চয়ই লালাবাজারের অফিসে বসে ব্যবসা করবে না কিন্তু ছোট ছেলে পড়াশুনা শেষ করে কী করবে, তা এখনই বলা মুশকিল।
দুএক মিনিট চুপ করে থাকার পর নরোত্তম বললেন, সুবল নিজের মত নতুন করে ব্যবসা করুক, তাতে আমার আপত্তি নেই। তবে আমি নিজে আর ব্যবসা বাণিজ্য করব না।