এইসব খবর উলুবেড়ে পৌঁছবার পর ঘরে ঘরে সে কি হাসিঠাট্টা আর আলোচনা। কেদার মিত্তিরের বৈঠকখানায় সেদিন কেউ দাবা না খেলে শুধু মিস্টার গ্রীন সোরকারকে নিয়ে হাসাহাসি করেই কাটিয়ে দিলেন। যদু মোক্তার হাসতে হাসতে বললেন, আমার ঠাকুমা বলতেন–
ধানের ব্যাপারী এল আফিঙের ভাউ জানতে
ঘুঁটে কুড়ানীর বেটা এল ধুতি-উড়ানি কিনতে।
উনি একটু থেমে বলেন, গিরীন হারামজাদারও হয়েছে তাই। লাটের বাড়ির ডাকঘরের পিয়ন যদি কোট-প্যান্ট পরে আর মদ খেয়ে সাহেব হতে পারতো তাহলে আর দুঃখ কি ছিল?
শুধু কর্তাদের আড্ডায় নয়, ঘোষেদের পুকুরঘাটে সারা পাড়ার বউ-ঝিদের মধ্যেও কি কম হাসাহাসি! নন্দ বোসের বউ হাসতে হাসতে বলেন–
মনে করছেন ছিদাম ঘোষ কোলে করবেন নাতি।
সে আশ্বাসে পড়ল ছাই, বউ নয় পোয়াতি।
ওঁর কথা শুনে অন্য সবাই হেসে ওঠেন। তারই মধ্যে নন্দ বোসের বউ বলেন, সরকার বাড়ির কর্তা বোধহয় ভেবেছিলেন উনি ফিরিঙ্গি মাগী নিয়ে ঘর করছেন বলে উলুবেড়ের বউঝিরা আনন্দে গাউন পরে নাচতে শুরু করবে। আঁটা মারো অমন মিনসের কপালে!
তবে উলুবেড়ের লোকজন যে যাই বলুন, গ্রীন সোরকারও কম হুঁশিয়ার ছিলেন না। ঐ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ছুঁড়িকে দেখিয়ে আর লর্ড কার্জনের এক বিশ্বস্ত কর্মচারী ক্যাপ্টেন বেলকে তৈল মর্দন করে সরকারবাড়ির ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
গ্রীন সোরকার উলুবেড়ে না গেলেও তার প্রথম পক্ষের ছেলেরা নিয়মিত ওঁর বৌবাজারের বাড়িতে যাতায়াত করতেন।
–গুড মর্নিং স্যার ক্যাপ্টেন! ক্যাপ্টেন বেলকে আসতে দেখেই গ্রীন সোরকার ছত্রিশ পাটি দন্ত বিকশিত করে ডান হাত মাথায় তুলে সেলাম দেন।
–ইয়েস গ্রীন, এনি লেটার?
–স্যার ক্যাপ্টেন, নো লেটার টু-ডে বাট মাই এক্স ইন্ডিয়ান ওয়াইফ সন স্যালুট ইউ।
ক্যাপ্টেন বেল মুচকি হেসে বলেন, কোথায় তোমার ছেলেরা?
-স্যার ওয়ান মিনিট কামিং।
একটু পরেই গ্রীন সোরকার তার ভূতপূর্ব ভারতীয় স্ত্রীর তিন পুত্রকে নিয়ে ক্যাপ্টেন বেল এর ঘরে ঢুকেই ছেলেদের বলেন, ক্যাপ্টেন স্যারকে স্যালুট কর।
ছেলেরা পিতৃ-আজ্ঞা পালন করে। তারপর গ্রীন ক্যাপ্টেনের সঙ্গে একে একে ছেলেদের পরিচয় করিয়ে দেন, স্যার, নাম্বার ওয়ান সন সতীশ ওয়ারশিপ কিংকুইন এভরিডে; নাম্বার টু সন গিরীশ পাক্কা সাহেব, রিড ইংলিশ, হেট সংস্কৃত অ্যান্ড বেঙ্গলি; ফাঁইনাল সন নীতীশ নট গো কালী মন্দির, ওয়ারশিপ গ্রেট জেসাস।
গ্রীন এখানেই থামেন না। সাহেবকে খুশি করার জন্য বলেন, স্যার অল সনস্ হেট সুরেন বাঁড়ুজ্যে অ্যান্ড পোয়েট্রি রাইটার রবীন্দ্রনাথ টেগোর।
.
বাংলাদেশে তখন হই হই ব্যাপার। আই-সি-এস পাস করা সুরেন বাঁড়ুজ্যে থেকে প্রিন্স দ্বারকানাথের নাতি রবিবাবুর কি মাথা খারাপ হয়েছে? ওঁদের মতো লোক পর্যন্ত কার্জনের মতো একজন পরম ভারত-হিতৈষীর বিরুদ্ধে সমস্ত বাঙালি জাতটাকে খেপিয়ে তুলল? যাই হোক, তখন মহানুভব সরকারের কিছু বেইমান বাঙালির দরকার। এইসব বেইমান বাঙালিদের বিচারবুদ্ধি না থাকলে আরো ভাল। সুতরাং ক্যাপ্টেন বেলএর অনুগ্রহে গ্রীন সোরকারের থ্রি সনএর রাজপূজা করার দুর্লভ সুযোগ এলো। সতীশ আর গিরীশ বেঙ্গল পুলিশে ও নীতীশ কলকাতা পুলিশের কনস্টেবল হওয়ায় উলুবেড়ের লাটবাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। গ্রীন সোরকারও অকৃতজ্ঞ ছিলেন না। নগদ বত্রিশ টাকায় এক ডজন স্যাম্পেনের বোতল কিনে ক্যাপ্টেন বেলএর কোয়ার্টারে হাজির হয়ে বললেন, স্যার লঙ লঙ স্যালুট টু ইউ। স্যার, ইউ গড! মাই সনস স্যালুট ইউ লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাইমস্!
না, গ্রীন সোরকারের তিন ছেলেও বেইমানি করেননি, তারা ইংরেজ সরকারের সেবায় মন-প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন এবং তিনজনেই যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দেন। সতীশ কুষ্ঠিয়া বোমার মামলার এক আত্মগোপনকারী বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করে এ এস আই পদে উন্নীত হয়ে মেদিনীপুরে বদলি হন। মেদিনীপুরের যেসব আদর্শভ্রষ্ট যুবকরা মহামান্য ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ করেন, তাঁদের বিভীষিকা ছিলেন সতীশ সরকার। বিপ্লবীদের শায়েস্তা করতে তার জুড়ি ছিল না সারা মেদিনীপুরে। শুধু মহিষাদল আর তমলুকেরই পাঁচজন বিদ্রোহীকে ইনি গুলি করে হত্যা করে স্বয়ং মহামান্য লাটসাহেবের হাত থেকে প্রশংসাপত্র ও পদক লাভ করেন। উলুবেড়ের লাটবাড়ির সামনের ঘরে এই অবিস্মরণীয় ঘটনার ছবি বহুকাল শোভা পেয়েছে। এখনও বোধহয় ভিতরের কোনো ঘরে সে ছবি টাঙানো আছে। মেদিনীপুরের বিপ্লবীরাও অকৃতজ্ঞ ছিলেন না।
.
সেদিন ছিল দুর্গাপূজার মহাষ্টমী। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব হিংসা-দ্বেষ ভুলে মহিষাদল-তমলুকের সমস্ত মানুষ পূজার আনন্দে মেতে উঠেছেন। জেলা পুলিশের ঝান গোয়েন্দারা নিশ্চিতভাবে জেনেছিলেন, না, এখন কয়েকদিন কোনো গণ্ডগোল হবে না। সতীশ সরকার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের আগেই উলুবেড়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। উনি তিন দিনের ছুটি নিয়ে মহাষ্টমীর দিন সকালবেলায় তমলুক থেকে বাসে মেচেদা স্টেশনে এসে উলুবেড়ের ট্রেন ধরার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ট্রেন আসার তখনও আধ ঘন্টা দেরি। তাছাড়া মহাষ্টমীর দিন! কোন বাঙালি সেদিন ঘর ছেড়ে বেরুবে? প্লাটফর্মে দু একজন যাত্রী এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন। একটু পরে দুজন মাঝারি বয়সী বৈষ্ণব খোল-করতাল বাজিয়ে কীর্তন গাইতে গাইতে প্ল্যাটফর্মে এসে হাজির। কীর্তন শুনিয়ে দুএকজন যাত্রীর কাছ থেকে ভিক্ষা নিয়ে ওঁরা সতীশ সরকারের কাছে এসেই খোল করতাল বাজিয়ে কীর্তন শুরু করে দিলেন।