এই বিয়ের আগেই নিমন্ত্রণপত্র পাবার পরই বসু পরিবারের আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশীদের মধ্যে সে কি হাসিঠাট্টা! করবে না কেন? বসু পরিবারের অর্ধেক আত্মীয় স্বজনই তো চীনাবাজার-কলুটোলা-মুগীহাটা-স্ট্রান্ড রোডের আশেপাশেই ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন কয়েক পুরুষ ধরে। এছাড়া বেশ কিছু আত্মীয়-স্বজন ক্লাইভ স্টিট-ক্যানিং স্ট্রিট ডালহৌসির নানা সওদাগরী অফিসে চাকরি করেন। এঁরা কাজে-অকাজে হরদম আত্মীয়দের দোকানে যান। সুতরাং উলুবেড়িয়ার লাটবাড়ি খ্যাত সরকার পরিবারের পরম শ্রদ্ধেয় উত্তরাধিকারীকে অনেকেই চেনেন। খুব ভাল করেই চেনেন।
প্রফুল্লচরণে মাসশ্বশুর ও বার্ড কোম্পানির ছোট ক্যাশবাবু হীরেন্দ্রনাথ নেমন্তন্নর চিঠিটা পড়েই নিকেলের চশমাটা একটু তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি লাট্ট সরকারের নাতনীর সঙ্গে বন্ধুর বিয়ে দিচ্ছ?
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
হাজার হোক বার্ড কোম্পানির ছোট ক্যাশবাবু! উঠতে-বসতে খাস বিলিতি সাহেবদের সঙ্গে কাজ-কারবার। ধুতির মধ্যে শার্ট খুঁজে উপরে কোর্ট ও পায়ে কালো বুট পরে অফিস যান। বৈঠখানায় কুইন ভিক্টোরিয়ার বিরাট ছবি। এক কথায় আত্মীয় স্বজন মহলে পাক্কা সাহেব বলেই খ্যাত। ইংরেজদের মতো কম কথার মানুষ। তবু উনি দুচারটি কথা জিজ্ঞেস না করে পারেন না। হীরেন্দ্রনাথ গম্ভীর হয়ে বলেন, তার মানে। তোমার ভাবী পুত্রবধূ ঐ স্কাউন্ড্রেল যতের মেয়ে?
কথাটা শুনেই প্রফুল্লচরণের পিঠে একটা চাবুকের ঘা পড়ল। সারা শরীর-মন জ্বলে ওঠে কিন্তু বার্ড কেম্পানির ছোট ক্যাশবাবুর সামনে প্রতিবাদ করার সাহস হয় না। শুধু বলেন, তাঁ, যতীনবাবুর মেয়ের সঙ্গেই বন্ধুর বিয়ে দিচ্ছি।
–ঐ অশিক্ষিত মুখ জোচ্চর ছোটলোকটা এখন তোমার কাছে যতীনবাবু হয়েছে?
. প্রফুল্লচরণ মাথা নিচু করে থাকেন।
-তোমরা সুখে থাকো। কিন্তু ঐ ছোটলোকের বাড়িতে আমি বরযাত্রী যেতে পারব না।
প্রফুল্লচরণ অত্যন্ত বিনম্রভাবে নিবেদন করেন, দয়া করে অহীন্দ্রবাবুকে যাবার অনুমতি দেবেন।
–ভুলে যেও না প্রফুল্ল, অহি আমার ছেলে এবং বেঙ্গল গভর্নমেন্টের ওভারসিয়ার। তারও একটা মান-মর্যাদা আছে।
-বৌভাতে…
–সে ভেবে দেখব।
একমাত্র ছেলের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে গিয়ে অধিকাংশ আত্মীয়-স্বজনের কাছেই প্রফুল্লচরণকে এই ধরনের কথা শুনতে হয়েছে।
চীনাবাজারে ভোলনাথ মুখার্জি অ্যান্ড সন্সের দোকানের ঠিক উল্টোদিকেই প্রফুল্লচরণের বড় শালার দোকান। সে তো নেমন্তন্ন চিঠি পড়ে হেসেই খুন।–সত্যি প্রফুল্ল, তুমি এই মেয়ের সঙ্গে বন্ধুর বিয়ে দিচ্ছ?
তবে কি আমি বিয়ে করছি? প্রফুল্লচরণ একটু রেগেই জবাব দেন।
বড় শালা নিবারণবাবু এবার বেশ গম্ভীর হয়েই বলেন, ভুলে যেও না প্রফুল্ল, বন্ধু শুধু তোমার ছেলে না, আমার ছোটবোনেরও ছেলে এবং আমি তার বড় মামা। চীনাবাজার-ক্যানিং স্ট্রিটের সবাই জানে, ভোলা মুখুজ্যের মতো শিবতুল্য মানুষটাকে যতে সকার চক্রান্ত করে একটা বেশ্যার কাছে ভিড়িয়ে দিয়ে তার ব্যবসাটা নিজের করে নেয়।
প্রফুল্লচরণ মাথা হেঁট করে বড় শালাবাবুর কথা শোনেন।
তুমি কি ভেবেছ, তুমি হয়তো কোনো স্বার্থসিদ্ধির জন্য ঐ হতচ্ছাড়া ছোটলোকটার মেয়ের সঙ্গে বন্ধুর বিয়ে দিচ্ছ বলে আমি আনন্দে ধেই ধেই করে নাচব?
না, প্রফুল্লচরণ এবারও কোনো কথা বলেন না।
বিন্দুমাত্র দ্বিধা-সঙ্কোচ না করে নিবারণবাবু সব শেষে বলেন, তোমাকে আমি সাফ জানিয়ে দিচ্ছি প্রফু, এই বিয়েতে আমাদের পরিবার থেকে কেউ যেতে পারবে না।
যতীন সরকারের মেয়ের সঙ্গে বন্ধুর বিয়ে দেবার জন্য সবাই একটু অবাক না হয়ে পারলেন না। অনেকেই সন্দেহ করলেন, য়তে সরকার নিশ্চয়ই এমনভাবে প্রফুচরণকে হাত করেছে যে এই বিয়ে না দিয়ে উপায় নেই। সে কি শুধু একশ ভরি সোনা আর এগারো হাজার টাকা নগদ? নাকি আরো কিছু?
নিবারণবাবুর স্ত্রী সব শুনে একটু মুচকি হেসে বললেন, একাদশীর ঠাকুরানী, ডুব দিয়ে খান পানি। ঠাকুরজামাই ভাবেন, আমরা আর কিছু বুঝি না। ওঁর নিজের কোনো স্বার্থ বা দুর্বলতা না থাকলে ঐ ঘরের মেয়েকে উনি পুত্রবধু করে আনেন?
নিবারণবাবুর ছোটভাই পঞ্চানন বললেন, ঠিক বলেছে বৌঠান! আমাদের এই দাদাবাবুটি যে অতীব ঘোড়েল, তা আর জানতে কারুর বাকি নেই।
বড় বৌঠান একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, ঠাকুরপো, আমি বাগনানের মেয়ে। আমার দিদি বিয়ে হয়েছে উলুবেড়ে। লাটবাড়ির ইতিহাস আমার জানতে বাকি নেই।
–শুধু আপনি কেন বৌঠান, দুনিয়ার সবাই জানে যতে সরকারের ঠাকুরদাদা লাটসাহেবের বাড়ির ডাকঘরের পিয়ন ছিল বলেই উলুবেড়ের লোক ঠাট্টা করে ওদের বাড়ির নাম দিয়েছিল লাটবাড়ি।
.
উলুবেড়ের এই লাটবাড়ি ইতিহাস সত্যি বিচিত্র। যতে সরকারের ঠাকুরদাদা গিরীন সরকার লাটসাহেবের বাড়ির ডাকঘরের পিয়নগিরি করেই পাকা সাহেব হয়ে ওঠেন। নেড়িকুকুরের মতো কিছু সাহেবকে খুশি করার জন্য উনি কোর্টে গিয়ে হলফনামা করে। নিজের নাম বদলে হন মিস্টার গ্রীন সোরকার। শুধু তাই নয়। দেশী পোশাক ত্যাগ করে কোটপ্যান্ট ধরলেন। বউ গাউন পরতে রাজি না হওয়ায় মিস্টার গ্রীন এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ছুঁড়িকে বিয়ে করে বৌবাজারে নতুন সংসার পাতলেন। সন্ধের পর একটু বিলিতি ওষুধের সঙ্গে সোডা মিশিয়ে দুচার গেলাস পেটে না পড়লে ওঁর কিছুতেই ঘুম আসতো না।