বৃদ্ধ অঘোরনাথ কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলেন, কি যে বলো ছোট মা? আমি আবার ওদের জন্য খরচ করলাম কবে?
কণিকা হাসতে হাসতে বলেন, এই দিন দশেক আগে পার্ক স্ট্রিটের রেস্টুরেন্টে ডিনার দিলেন কাদের জন্য?
ওঃ! অঘোরনাথ হেসে বলেন, বাপের বিয়ের পর ঐ তো প্রথম ঢোলে কাঠি পড়ল! তাছাড়া ওটা খুবই স্পেশাল ব্যাপার ছিল।
নাতি-নাতনীদের সবকিছুই স্পেশাল।
অঘোরনাথ মালতী দেবীর দিকে তাকিয়ে বলেন, আচ্ছা তুমিই বলল বৌমা, নাতির সঙ্গে যাদবপুরে একটি মেয়ে এঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। মেয়েটি রূপে-গুণে কথায়-বার্তায় এত ভাল যে তোমাকে কি বলব। বৃদ্ধ একটু হেসে বলেন, মেয়েটির সঙ্গে আমার আবার খুবই ভাব-মানে ভেরি স্পেশাল ভাব। এখন ঐ মেয়েটির সঙ্গে জন্মদিনে আমি নাতি নাতনী আর তাদের কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবকে নিয়ে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে কি অন্যায় করেছি?
ঘটনাটা শুনেও মালতী দেবীর মন খুশিতে ভরে যায়। বলেন, না, না, অন্যায় করবেন কেন।
–ঐ শোনো ছোট মা, বৌমা কি বলছেন।
কণিকা হেসে বলেন, মেজদি, তোমাকে পরে আমি সব বলব।
যাই হোক, এই বাঁড়ুজ্যে বাড়ি থেকেই ওঁদের মেজ মেয়ের বিয়ের সময় পুরো এক হাজার টাকার জিনিসপত্র কিনে দেন। এমনকি ঐ সরকার বাড়ির বুড়ি কামিনীবালা পর্যন্ত একটা নাকছাবি মালতী দেবীর হাতে দিয়ে বলেছিলেন, বৌমা, আমার তো আর সেদিন নেই; তাছাড়া যা সামান্য কিছু ছিল, তাও হতভাগা নাতিদের কল্যাণে শেষ হয়েছে। এটা ছাড়া আর কিছু নেই! তুমি এটা ভেঙেচুরে ওকে যা হয় করে দিও।
.
স্বামীর কল্যাণে মালতী দেবী কার কাছে হাত পাতেননি? বাইরের দরজা থেকে রান্নাঘরে ফিরে আসতে আসতেই এইসব মনে পড়ে ওঁর। এমন সময় সিঁড়িতে চটির আওয়াজ শুনেই পিছন ফিরে দেখেন, সন্তোষ নামছে।
ওকে দেখেই মালতী দেবী বলেন, সন্তোষ, বাবা একটা কথা শুনবে?
সন্তোষ তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলে, হ্যাঁ কাকিমা, বলুন।
–এখানে না, ঘরে এসো।
সন্তোষ ওঁর পিছন পিছন ঘরে ঢুকতেই মালতী দেবী বলেন, তুমি যদি রাগ না করো, তাহলে একটা কথা বলতাম।
সন্তোষ একগাল হাসি হেসে বলে, আপনি কি যে বলেন! আমি আপনার উপর রাগ করতে পারি? আপনি বলুন কি বলবেন।
বাবা, কিছু টাকার দরকার কিন্তু..
কাকিমা, আপনি আমার মায়ের মতো। আপনি আমাকে বেশি বললে লজ্জা পাব।
–কিন্তু বাবা।
–আপনার কত টাকার দরকার?
–হাজার খানেক হলে খুব ভাল হয়; আর তা না পারলে…
সন্তোষ বলল, আমি দোকানে বেরুবার সময় আপনাকে দিয়ে যাব।
না, না, তখন কাকা থাকবেন। ওঁর সামনে দিও না। মালতী দেবী লুকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, উনি টাকার কথা জানতে পারলেই হয়তো অফিস কামাই করে রেসের মাঠে বসে থাকবেন।
-তাহলে দুপুরবেলায় কোনো এক সময় আমি আসব।
–হ্যাঁ, সেই ভাল।
-তবে কাকিমা, এই টাকার কথা যেন কেউ না জানে। মানে আমি আর আপনি ছাড়া কেউ জানবে না।
–আচ্ছা বাবা, তাই হবে।
সন্তোষ ঘর থেকে বেরুবার জন্য পা বাড়িয়েও ফিরে এস বলে, আর একটা কথা কাকিমা; আপনার যখন যা দরকার আমাকে বলবেন। একটুও লজ্জা করবেন না।
মালতী দেবী দুহাত দিয়ে ওর মুখখানা ধরে বলেন, তুমি সুখী হও বাবা। এমন কথা আমার স্বামী বা ছেলেরাও কোনোদিন বলেনি, বলবেও না।
–এই পটল, তোর দাদুকে বলে দে, এই বারান্দাটা পেচ্ছাব পায়খানা করা বা মুখ ধোবার জায়গা না।
বারান্দায় এক কোনায় বসে রান্না করতে করতেই আড় চোখে মেজ শ্বশুর অমূল্যচরণকে বারান্দার অন্য দিকের কোনায় বসে মুখ ধুতে দেখেই বন্ধু বসুর বউ শুধু ঐটুকু বলেই থামেন না। আরো অনেক কথা বলার পর শ্রীমতী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, পোড়া কপাল করে এসেছি বলেই এইসব জংলিগুলোকে নিয়ে সংসার করতে হচ্ছে।
অমূল্যচরণ এসব কথা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দেন। বন্ধুর বউয়ের কথাবার্তার ধরনই এইরকম বলে উনি বিশেষ পাত্তা দেন ন। এই মেয়ের সঙ্গে বন্ধুর বিয়ের সম্বন্ধ হবার সময়ই উনি বড়ভাইকে বলেছিলেন, দাদা, যে লোকটা এককালে আমাদের পাশের দোকানের কর্মচারী ছিল ও পরে মালিককে ঠকিয়ে দোকানটা নিজের করে নেয়, তার মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিও না।
প্রফুল্লচরণ বলেছিলেন, কিন্তু মেয়েটিকে যে আমার বড় পছন্দ হয়েছে।
মেয়েটি যত সুন্দরই হোক, ওর শরীরে তো ঐ বেইমান যতীন সরকারের রক্ত আছে। এই বেইমানের মেয়েকে পুত্রবধূ করে ঘরে আনলে কি তুমি খুব সুখী হবে?
-কোন মেয়েকে ঘরে এনে যে সুখী হবে, তা তো শুধু ভগবানই জানেন। প্রফুল্লচরণ একটু থেমে বলেন, তাছাড়া আমাদের পরিবারের কথা জানে বলেই যতীন একশ ভরি সোনা, এগারো হাজার টাকা নগদ আর মণ পাঁচেক কাঁসার বাসন দিচ্ছে।
অমূল্যচরণ গম্ভীর হয়ে বলেন, এই যুদ্ধের বাজারে জোচ্চুরি করে লাখ লাখ টাকা কামাচ্ছে বলেই..
মেজভাইকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই প্রফুল্লচরণ বেশ বিরক্তির সঙ্গেই বলেন, এই যুদ্ধের বাজারে কোন ব্যবসাদার জোচ্চুরি করে পয়সা কামাচ্ছে না? আমরা খদ্দেরদের ঠকিয়ে বেশি কামাচ্ছি না? যত দোষ যতীন সরকারের?
না, এর পর অমূল্যচরণ আর তর্ক করেন নি। যথারীতি মাঘ মাসের এক শুভদিনের শুভলগ্নে স্বর্গীয় রায়সাহেব সারদাচরণ বসুর প্রপৌত্র, স্বর্গীয় বরদাচরণ বসুর পৌত্র ও শ্ৰীযুত্তবাবু প্রফুল্লচরণ বসুর একমাত্র পুত্র পরম কল্যাণীয় শ্রীমান বঙ্কিমচরণের সহিত উলুবেড়িয়ার লাটবাড়ি খ্যাত সরকার পরিবারের পরম শ্রদ্ধেয় উত্তরাধিকারী শ্ৰীযুক্তবাবু যতীন্দ্রনাথ সরকার মহোদয়ের তৃতীয়া কন্যা পরম কল্যাণীয়া শ্রীমতি উমারানীর শুভ পরিণয় সুসম্পন্ন হইল।