মিঃ ঘোষ হো হো করে হেসে ওঠেন। তারপর হাসি থামলে বলেন, এর চাইতে গুণী ছেলে আমাদের দরকার নেই।
কিশোরবাবু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলেন, অথচ হি কামস ফ্রম এ ভেরি ভেরি গুড ফ্যামিলি, আর ছেলেটাকে প্রপারলি ডিল করলে দেখবেন, হি ইজ নট এ ব্যাড এলিমেন্ট।
.
উনুনে ডাল বসাতে বসাতেই মালতী দেবী ডান দিকে মুখ করে একটু গলা উঁচু করে বলেন, হ্যাঁগো, বাজার যাবে না?
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে রামপ্রসন্ন মিত্তির পুরনন ফিল্ম ম্যাগাজিনে ডিম্পলের একটা সুন্দর ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করেছেন, ঠিক সেই সময় বাজার যাবার কথা শুনে ওঁর মেজাজ বিগড়ে গেল। বললেন, এত বেলায় বাজার যাবার কথা বলছ?
মালতী দেবী উঁকি দিয়ে একবার টাইমপিস দেখেই বলেন, মোটে তো সাতটা বাজে। এর আগে আবার কবে তুমি বাজারে যাও?
ডিম্পলের ছবি দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে যান রামপ্রসন্নবাবু। তাই স্ত্রীর কথা শুনেও যেন শুনতে পান না। একটু পরে বলেন, মন্টুকে বলো না, একটু বাজার যেতে।
তাকে পাব কোথায়? তিনি রাজ্যসম্মেলন নিয়ে এতই ব্যস্ত যে ভোর ছটায় বেরিয়ে গেছেন।
রেখা-হেমা মালিনী-শ্রীদেবীর নানা ভঙ্গিমার ছবি দেখতে দেখতেই উনি বলেন, ছেলেকে বলে দিও, মিছিল-মিটিং করে পেটও ভরবে না, দেশেরও কিছু হবে না।
-তুমি বলে দিও। মালতী দেবী তরকারির ছোট্ট ঝুড়িটা একবার দেখে নিয়েই আবার বলেন, কিগো, বাজার যারে না?
–ডিম নেই?
–আছে।
-তাহলে ঐ ডিম দিয়েই আজ চালিয়ে নাও।
–কিন্তু যা ডিম আছে, তা দিয়ে তো দুবেলা সবার হবে না। এবার মালতী দেবী ঘরে ঢুকে স্বামীকে দেখে একটু হেসে বলেন, সিনেমা ম্যাগাজিন আনার জন্য খুকির উপর রাগ করো, কিন্তু আমি তো দেখি এইসব বই পড়তে তোমারই আগ্রহ সব চাইতে বেশি।
.
অবস্থার গুরুত্ব মালতী দেবী খুব ভালভাবেই বোঝেন এবং জানেন। যেদিন ভবানীপুরের দেবীপ্রসন্ন মিত্তিরের পুত্রবধূ হয়ে এই বাড়িতে প্রথম আসেন, সেদিন ওঁর মনে কত স্বপ্ন, কত আনন্দ! স্বামী তখনও কলেজের ছাত্র কিন্তু তবুও স্থির জানতেন এত বড় পরিবারের ছেলে কিছু না কিছু হবেই। তাছাড়া শরৎ বোসের পরম স্নেহভাজন আস্থাভাজন উকিল দেবীপ্রসন্ন মিত্তিরের ছেলে হয়তো ব্যারিস্টারও হতে পারেন। অন্ততপক্ষে নামকরা উকিল নিশ্চয়ই হবেন, কিন্তু হা ভগবান! কি ভেবেছিলেন আর কি হলো!
একটা ছেলেমেয়েকে নিয়েও শান্তি পেলেন না মালতী দেবী। পাঁচজনের একজনও মনের মতো হলো না। বড় ছেলে দুর্গাপুরে ইলেকট্রিকের মিস্ত্রীর কাজ করছে, একথা লোককে বলতেও ঘেন্না হয়। মন্টুও যেভাবে রাজনীতিতে মেতেছে, তাতে বেশ বোঝা যাচ্ছে ওর ভবিষ্যও বিশেষ উজ্জ্বল না। আর তিনটি মেয়ে তো তিনটি অবতার! ছোটটিকে নিয়ে এখনও তেমন কোনো ঝামেলা ভোগ করতে হয়নি ঠিকই, কিন্তু ও যে দুই দিদির মতো যন্ত্রণা দেবে না, তার কি নিশ্চয়তা আছে?
দুটি মেয়ের এমনই খ্যাতি ছিল যে তাদের পার করতে খেসারত দিতে হয়েছে অনেক। না দিয়ে কোনো উপায় ছিল না। বড় খুকির বিয়ের সময়েই তো দোতলাটা গুপ্তাজিদের দিয়ে যে টাকা অ্যাডভান্স পাওয়া গেল, তাই দিয়ে কোনমতে মান রক্ষা হলো। মেজ খুকির বিয়ের সময় কার কাছে হাত পাততে হয়নি? এ পাড়ায় যে কঘর পুরনো বাঙালি আছেন, তারা প্রত্যেকেই কম-বেশি সাহায্য করেছিলেন এবং স্বেচ্ছায়। কারণ রামপ্রসন্ন মিত্তিরের অবস্থা কে না জানেন? কে না জানেন দেবী মিত্তিরের মৃত্যুর পর রাম মিত্তির রেস খেলে সব উড়িয়েছেন? তাই তো পাড়ায় কারুর কাছে ওঁর মুখ দেখাবার উপায় নেই। এমনকি মেয়ের বিয়ের সময়েও উনি পুরনো প্রতিবেশীদের বাড়ি যাননি।
.
মালতি দেবী অঘোর বাঁড়ুজ্যেকে প্রণাম করে কার্ডটা হাতে দিতেই উনি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, বৌমা, কার বিয়ে?
–মেজ মেয়ের।
বাঃ! খুব আনন্দের কথা। উনি সঙ্গে সঙ্গে ছোট ভাইপো নীতীশের স্ত্রীকে ডেকে বললেন, ছোট মা, বৌমা এসেছে মেজ মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন করতে।
নীতীশবাবুর স্ত্রী কণিকা একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ আমি জানি।
–আজকালকার দিনে মেয়ের বিয়ে দেওয়া তো সহজ ব্যাপার না।….
–সে তো একশবার।
বৃদ্ধ অঘোরনাথ কণিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, তুমি আমার অ্যাকাউন্ট থেকে পাঁচশ টাকার চেক কেটে নীতুকে দিয়ে বলবে, ও নিজেও যেন শআড়াই দেয়। তারপর তুমি বৌমার সঙ্গে পরামর্শ করে ঐ সাড়ে সাতাশ দিয়ে বিয়ের কিছু জিনিসপত্র কিনে দিও।
কণিকা দেবী একটু হেসে বলেন, ছোট কাকা, আপনি রিটায়ার্ড হয়ে যদি পাঁচশ দেন, তাহলে আপনার ছেলে আড়াইশ দেবে কেন? তারও অন্তত পাঁচশ দেওয়া উচিত।
মালতী দেবী অবাক হয়ে ওঁদের দুজনের কথা শোনেন।
অঘোরনাথ একটু মধুর হাসি হেসে বলেন, আমার যা কিছু দরকার তা সবই তো তোমরা দাও; আমার আর খরচা কোথায়। তোমাদের তো এখনও অনেক দায়-দায়িত্ব পড়ে আছে।
–নাতি-নাতনীদের জন্য আপনার খরচ কম?
–ওদের জন্য আবার কোথায় খরচা করি?
কণিকা দেবী একগাল হাসি হেসে মালতী দেবীকে বলেন, জানো মেজদি, ছোট কাকার সব টাকাকড়ি আমার নামেই ব্যাঙ্কে জমা আছে। দুদিন পর পরই উনি বলবেন, ছোট মা, হাত একেবারে খালি। কিছু টাকা তুলে দেবে?
মালতী দেবী মুগ্ধ হয়ে ওঁর কথা শোনেন।
নীতুবাবুর স্ত্রী বলেন, নাতি-নাতনীদের বাঁদরামির জন্য ছোট কাকা কীভাবে জলের মতো টাকা খরচ করেন, তা তুমি ভাবতে পারবে না।