ছোটকর্তার কথা শুনে কামিনীবালার মাথা ঘুরে যায়। লোকটা বলে কী? এই ওর সন্ধেবেলা? নববধূ দুর্গানাম শরণ করেন।
ছোটকর্তা আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে কামিনীবালার মুখের সামনে মুখ নিতেই উনি কি একটা বিচ্ছিরি গন্ধে মুখ ঘুরিয়ে নেন। ছোটকর্তা এক গাল হাসি হেসে বললেন, ভয় পেয়োনা ছোটগিন্নি। আজ শুভদিন বলে ইয়ার-দোস্তদের সঙ্গে বসে একটু সিদ্ধি খেয়েছি। কিচ্ছু ভয় পাবার নেই।
ওর কথা শুনে কামিনীবালার রক্ত প্রায় জল হয়ে যায়। জিভ তো শুকিয়ে কাঠ।
আবার ছোটকর্তার মুখে সেই হাসি। উনি বলেন, হাজার হোক আমি সরকারবাড়ির ছোটকর্তা। এমনি সিদ্ধি তো মুখে রোচে না; তাই বিলিতি সিদ্ধি খেয়েছি।
.
দত্তদের ঐ পুরনো বাড়িটার সামনে দুতিনটে গাড়ি এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে পাঁচ সাতজন নেমে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন দেখাতে দেখাতে আলাপ-আলোচনা করছেন। এই গাড়িগুলি চেপে এঁরাই আরো কয়েকবার এসেছেন। মাসখানেক আগে এক রবিবার সকালে দুএকজন ভদ্রলোকের সঙ্গে তিন-চারজন বয়স্কা মহিলাও এসেছিলেন। ঐ মহিলারা বাড়ির চারদিক ঘুরে-ফিরে দেখার পর ভিতরেও গিয়েছিলেন।
ভদ্রলোকেরা নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনার পর একটা গাড়ির বনেটের উপর একটা বিল্ডিং প্ল্যান রেখে কত কি কথাবার্তা বললেন। প্রায় আধঘণ্টা আলাপ-আলোচনার পর এক ভদ্রলোক বাড়ির পিছন দিকের দোতলা থেকে বিশুবাবুকে ডেকে আনলেন।
কোনো ভূমিকা না করেই কেশব আগরওয়াল ওঁকে প্রশ্ন করলেন, বিসুবাবু, আপনি কবে শিফট করছেন।
বিশুবাবু লুঙ্গি ঠিক করতে করতে বললেন, শিফট তো আমি কালই করতে পারি, কিন্তু সোনারপুরের স্কুলে ছেলে দুটোকে ভর্তি না করা পর্যন্ত…
-কিন্তু আমরা তো কাল থেকেই বিল্ডিং ভাঙা শুরু করছি।
কাল থেকেই?
হাঁ, কাল থেকেই। কেশববাবু সিল্কের পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা রুপোর কৌটো বের করতে করতে বলেন, এখন আর ভবানীপুরে দো-তিনতলা বাড়ি বানিয়ে পোসাবে না। কমসে কম ছতলা না হলে পরতায় পোসাবে না। কিন্তু সামনের দেওয়ালীর আগে, এই ছতলা কমপ্লিট না করতে পারলে আমাদের মিনিমাম চালিস লাখ টাকা লুকসান হবে।
বিশুবাবু ওঁর কথা শুনে চুপ করে থাকেন।
কেশববাবুর রুপোর কৌটো থেকে পান-জর্দা মুখে দিয়ে বলেন, আপনি রবিবারের মধ্যে পজিটিপলি চলে যাবেন।
কেশববাবুর বড়ছেলে কিশোরবাবু এই কলকাতা শহরেই জন্মেছেন। প্রথমে দয়ানন্দ সরস্বতী স্কুলে ও পরে সিটি কলেজে লেখাপড়া করেছেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বাপের ব্যবসায় নিত্য যাতায়াত করে এই চল্লিশ বছর বয়সেই পাকা ব্যবসাদার হয়েছেন। এই দত্ত পরিবারের এক আত্মীয়ের সঙ্গে ওঁর বন্ধুত্ব আছে এবং সেই সূত্রেই এই সম্পত্তি ওঁরা কিনতে পেরেছেন। এই পরিবারের সবকিছুই উনি জানেন এবং ওঁর উপর কেশববাবুর ষোল আনা আস্থা আছে। তাই তো উনি সোজাসুজি বিশুবাবুকে বললেন, দেখুন বিশুবাবু, আপনার সঙ্গে এই দত্ত ফ্যামিলির কোনো ডাইরেক্ট সম্পর্কও নেই; অথচ একটি পয়সা ভাড়া না দিয়ে সারাজীবন এই বাড়িতে বেশ কাটিয়ে দিলেন। আমরা নিছক ভদ্রলোক বলে আপনাকে কিছু টাকা দিয়েছি। যাই হোক, আপনি রবিবারের মধ্যেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন।
বিশুবাবু এদের নতুন দেখছেন না। সবই জানেন, সবই বোঝেন। বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটেদেরই যখন চলে যেতে হয়েছে, তখন ওঁকেও যে যেতে হবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবু উনি বললেন, যদি কাইন্ডলি আরো একটা সপ্তাহ টাইম দেন, তাহলে…
–অসম্ভব।
ইতিমধ্যে পাড়ার কয়েকজন ভদ্রলোক ওঁদের আশেপাশে জড়ো হয়েছেন। এঁদেরই একজন বললেন, বিশু, তুমি বিনা ভাড়ায় এত বছর কাটাবার পর এঁদের কাছ থেকে টাকা নিয়েও বাড়ি ছাড়ছ না?
কিশোরবাবু বেশ রাগ করেই বললেন, আই হ্যাভ পেড হিম ফাইভ থাউজ্যান্ত রুপিজ।
–পাঁচ হাজার! ভদ্রলোক এবার হেসে বিশুবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তো আচ্ছা ওস্তাদ লোক! ফোকটে পাঁচ হাজার পেয়েও বাড়ি ছাড়তে ….
পিছন দিক থেকে একটি ছোকরা বলল, বিশুদা, ক্লাবের পুজোর চাঁদা না দিয়ে কেটে পড়ো না।
এবার বিশুবাবু বললেন, ঠিক আছে, রবিবারের মধ্যেই আমি চলে যাব।
কিশোরবাবু মুখ ঘুরিয়ে এক ভদ্রলোককে বললেন, মিঃ ঘোষ, তাহলে কাল থেকেই কাজ শুরু করে দিন।
মিঃ ঘোষ বললেন, হ্যাঁ, কালই শুরু করব। বর্ষার আগে রিইনফোর্সড কনক্রিটের কাজ শেষ না করতে পারলে ভীষণ মুশকিলে পড়ব।
কাম হোয়াট মে, বর্ষার আগেই এই কাজ শেষ করতে হবে।
–সে তো একশবার। মিঃ ঘোষ এবার পিছন দিক ফিরে বললেন, মুখার্জিবাবু, মানিককে সব কথাই বলা আছে; তবু এখুনি একবার ওর অফিসে গিয়ে আরেকবার বলে আসুন কাল সকাল থেকেই কাজ শুরু হবে।
কিশোরবাবু ড্রাইভারকে বললেন, চন্দনকো জলদি বুলাইয়ে।
দুপাঁচ মিনিটের মধ্যেই চন্দন হাজির হয়েই বলল, কিশোরদা, আপনি আমাকে ডেকেছেন?
–শোন, কাল থেকেই আমাদের কাজ শুরু হচ্ছে। সুতরাং…
ব্যস ব্যস আর বলতে হবে না। এখান থেকে যদি একটা ইটও এদিক-ওদিক হয়, তাহলে চন্দন মুখুজ্যেকে জুতো পেটা করবেন।
কিশোরবাবু ওর পিঠে একটা চড় মেরে বললেন, তুই বড্ড বকবক করিস।
চন্দন চলে যেতেই মিঃ ঘোষ একটু হেসে বলেন, ছেলেটি বেশ গুণী মনে হলো।
কিশোরবাবু হেসে বলেন, খুব গুণী কি না জানি না; তবে পাতালরেলের লোহালক্কড় সিমেন্ট চুরির জন্য উইকে অন্তত একবার ওকে ভবানীপুর থানায় যেতেই হয়। মাত্র বার চারেক জেলও খেটেছে।