–আচ্ছা দেখি।
ভোরবেলায় নরোত্তম চলে যাবার আগে সাবিত্রী বলল, কী হয় আমাকে জানিও।
-হ্যাঁ, জানাবো।
.
গর্ডন সাহেব প্রথমেই প্রশ্ন করলেন, আমরা যে এজেন্ট রাখব, এ খবর তুমি জানলে কী করে?
-স্যার, আমার এক ফ্রেন্ড!
সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, দেখছি, তোমার ফ্রেন্ড তো ব্যবসা-বাণিজ্য দুনিয়ার অনেক গোপন খবর রাখে।
-হ্যাঁ, স্যার। নরোত্তমও হেসে জবাব দেয়। কিন্তু মনে মনে ভয় পায়, যদি এই বন্ধুর ব্যাপারে সাহেব আরো কিছু জানতে চান, তাহলে কী উত্তর দেবে।
যাই হোক, গর্ডন সাহেব পাইপ ধরিয়ে একটা টান দিয়েই বললেন, মিঃ মালিক, তোমাকে আমি এবার যেসব প্রশ্ন করব, তার জবাবে মিথ্যে কথা বলবে না।
–স্যার, ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে আমি কখনই মিথ্যে কথা বলি না। কারণ মিথ্যে কথা বলে ব্যবসা-বাণিজ্য বেশি দিন চালানো যায় না।
-ভেরি গুড।
. এবার প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে সাহেব ওকে জেরা করলেন। হাজার রকমের প্রশ্ন। সব শেষে সাহেব বড়বাবুকে ডেকে বললেন, বড়াবাবু, মিঃ মালিককেই আমরা এজেন্ট নিয়োগ করব। কাল সকাল ঠিক দশটায় উনি কাগজপত্র টাকাকড়ি নিয়ে আসবেন।
বড়বাবু বললেন, অল রাইট স্যার। আমি সবকিছু করে দেব।
–আর হ্যাঁ, এগ্রিমেন্ট সই হবার পরই আপনি ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে, বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে আর ই-বি-আর-এর চিফ এঞ্জিনিয়ারকে জানিয়ে দেবেন, ওঁরা যেন এবার থেকে মিঃ মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
–অল রাইট স্যার!
পরের দিন চুক্তি সই হবার পর গর্ডন সাহেব হাসতে হাসতে নরোত্তমকে বললেন, মিঃ মালিক, যদি ঠিক মতো ব্যবসা করতে পারো তাহলে পাঁচ বছরের মধ্যে কোটিপতিও হবে, রায়বাহাদুর উপাধিও পাবে।
নরোত্তম ছত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাত কচলে হাসতে হাসতে জবাব দেয়, স্যার, আপনার কৃপা ছাড়া আমার আর কিছু কাম্য নেই।
.
তখন এমন একটা সময় যখন ভাল ছুঁচ পর্যন্ত বিলেত থেকে আসতো; রেলের যন্ত্রপাতি তো দূরের কথা। তাই চুক্তি সই করার আগেই নরোত্তম মল্লিক জানতো, বছরে কয়েক লাখ টাকার মাল বিক্রি হবেই। কমিশন শতকরা দশ ভাগ থেকে খরচপত্তর বাদ দিয়েও বেশ মোটা টাকা লাভ থাকতে বাধ্য। কিন্তু নরোত্তম ভাবতে পারেনি, রেল কোম্পানিগুলো এত টাকার যন্ত্রপাতি কেনে।
বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ে থেকেই প্রথম চেক আসে। এক লাখ সত্তর হাজার তিনশ আঠাশ টাকা বারো আনা। সেইদিন রাত্তিরেই একটা লাল টুকটুকে বেনারসী আর হীরের নাকছাবি নিয়ে নরোত্তম সাবিত্রীবালার ওখানে হাজির।
সাবিত্রী এক গাল হাসি হেসে বলল, কিগো মল্লিকমশাই, আমাকে বিয়ে করবে নাকি?
–তোর সঙ্গে তো আমার বিয়ে অনেক আগেই হয়ে গেছে।
-তাই নাকি?
তবে কী?
–তবে কি আজ নতুন করে ফুলশয্যা হবে?
-এবার থেকে যেদিনই আসব, সেদিনই আমাদের ফুলশয্যা হবে।
–এত পিরিত সহ্য হবে তো?
হঠাৎ নরোত্তম গম্ভীর হয়ে বলে, দ্যাখ সাবিত্রী, আমি বেইমান না। তোর জন্যই আমি এই ব্যবসা করতে পারছি। সুতরাং এই ব্যবসা যত দিন চলবে, তোর কোনো চিন্তা নেই।
তুমি যে বেইমানি করতে জানো না, তা আমি ভাল করেই জানি; আর সেই জন্যই তোমাকে গর্ডন সাহেবের খবরটা বলেছিলাম।
সাবিত্রী একটু চুপ করে থাকার পর বলে, দেখো মল্লিকমশাই, তোমরা অনেক কিছু জানো কিন্তু পুরুষমানুষের আসল স্বভাব-চরিত্র শুধু আমরাই জানতে পারি।
-সে তো একশ বার।
কম বড়লোক তো দেখলাম না। সেই তেরো বছর বয়স থেকে একটা না একটা বড়লোক নিয়েই এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম।
সাবিত্রী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমি জানি, সরকারবাড়ির বড়কর্তা এই ব্যবসা করার সুযোগ পেলেও বেশিদিনও চালাতে পারতেন না।
-কী করে জানলি?
সাবিত্রী একটু মুচকি হেসে বলল, আমরা বাজারের মেয়ে। আমাদের না হয় ধর্ম অধর্ম জ্ঞান নেই। পয়সা পেলেই আমরা নিজেদের বিলিয়ে দিই, কিন্তু যে হারামজাদা নিজের বাড়ির সব বউ আর ঝিদের পর্যন্ত সর্বনাশ করেছে সে আবার ব্যবসা করবে?
–তুই কী করে জানলি?
সাবিত্রী এবার একটু জোরেই হাসে। বলে, পুরুষদের মতো বোকা জাত আছে নাকি? দুগেলাস মদ গিলিয়ে দেবার পর আমরা একটু বুকের কাছে টেনে নিলেই সব পুরুষের গলা দিয়ে সব কথাই বেরিয়ে আসে কিন্তু সকালবেলায় ঘুম ভাঙলে কোনো পুরুষই রাতের কথা মনে রাখতে পারে না।
–আর তোরা সব মনে রাখিস?
–একশবার রাখি। তোমাদের দুর্বলতা না জানলে এই ব্যবসায় টিকে থাকা যায়?
এবার নরোত্তম ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বলে, সত্যি মাগী তোর বুদ্ধি আছে।
.
চীনাবাজার-ক্যানিং স্ট্রিটের মোড়ে নরোত্তম মল্লিকের বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হবার কিছু দিন পরই একদিন ভবানীপুরের সরকার বাড়ি বড়কর্তা ওর গদিতে এসে হাজির। হাতের ছড়িটা পাশে রেখে উনি দুহাত জোড় করে বললেন, নমস্কার মল্লিকমশাই।
নমস্কার! মল্লিকমশাই অবাক হয়ে ওঁর দিকে তাকিয়েই বলে, আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না তো।
–আমার নাম নরনারায়ণ সরকার; থাকি ভবানীপুর, আর সামান্য ব্যবসা করি চীনেবাজারে।
কীসের ব্যবসা?
তেমন বলার মতো কিছু না, সামান্য কাগজের ব্যবসা করি। সরকার বাড়ির বড়কর্তা একটু হেসে বলেন, আপনি এক লরি বোঝাই যন্ত্রপাতি রেল কোম্পানিতে সাপ্লাই দিলে নিদেন পক্ষে বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা লাভ করতে পারেন আর আমি এক লরি কাগজ বোঝাই করলে, তার দাম পনের-বিশ হাজারও হয় না।