সত্যি নাকি?
–মা কালীর দিব্যি দিয়ে বলছি, ঐ সরকারবাড়ির বড়কর্তার চাইতে তোমাকে আমার হাজার গুণ ভাল লাগে।
-কেন? বড়কর্তা কী দোষ করল?
-সে কথা শুনে কী করবে? সাবিত্রীবালা একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আমার পোড়া কপাল বলে তুমি কোনোদিন নজর দিলে না। কী পাও ঐ মুটকি সুহাসিনীর কাছে?
ওর কথা শুনে নরোত্তম মল্লিক একটু না হেসে পারে না। বলে, আমার জন্য যে এত পিরিত তোর মনের মধ্যে জমা আছে, তা জানব কেমন করে?
–একটু নজর দিলেই জানতে পারতে। সাবিত্রীবালা একটু থেমে বলে, বাড়িতে যদি একটা বুড়ি আর একটা হুঁড়ি বউ রাখতে পারো,তাহলে দুটো মাগী রাখতে অসুবিধে কোথায়?
-তোকে পুষলে আমার কী লাভ?
মল্লিকমশায়ের দুহাতের বন্ধন থেকে হঠাৎ নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সাবিত্রীবালা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, দুচোখ দিয়ে একবার আমাকে ভাল করে দেখো। এমন রূপ-যৌবন কটা মাগীর দেখেছ?
মল্লিকমশাইকে কিছু বলতে না দিয়েই সাবিত্রীবালা সঙ্গে সঙ্গে বলে, তোমার আগে সুহাসিনী কোনো ভাল ব্যবসাদার ধরতে পেরেছে? ও তো চিরকাল শ্যালা বাজারের কিছু দোকানদারকে নিয়েই থেকেছে।
নরোত্তম চুপ করে ওর কথা শোনে।
–আর আমি? সাবিত্রীবালা বুড়ো আঙুল দিয়ে নিজেকে দেখিয়ে বলে, আমি কোনোদিন চুনোপুটি ছ্যাচড়া দোকানদারদের কাছে আমার দেহ দিইনি। আমি রুই কাতলা ছাড়া শিকার করি না।
নরোত্তম একটু মুচকি হেসে বলে, ওরে মাগী, তাতে আমার কী লাভ?
সাবিত্রীবালা অত্যন্ত রুক্ষদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, সব শালা ব্যবসাদারদের টিকি কেটে নেবার পর তবে আমি নিজেকে দিয়েছি।
–আমারও টিকি কেটে রাখবি?
সাবিত্রীবালা এক গাল হাসি হেসে দুহাত দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি মানুষকে ভালবাসতে জানো, তাদের সুখ-দুঃখ বুঝতে পারো। তাই তোমাব টিকি কেটে রাখার দরকার হবে না। আমরা বাজারের মেয়ে বলে কি মন বলে কিছু নেই?
মল্লিকমশাই ওর ভাবান্তর দেখে অবাক।
সাবিত্রীবালা খুব জোরে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, এই ছোটলোকগুলো কী করে লাখপতি হচ্ছে, তা আমার জানতে বাকি নেই, কিন্তু আমি যে কারুর উপকার করব, তার সুযোগই বা পেলাম কোথায়? এ দুনিয়ায় কেউই তো আমাদের বিশ্বাস করে না।
–আমি তোকে বিশ্বাস করি।
-সত্যি?
-তোকে ছুঁয়ে বলছি।
এক মুহূর্তের জন্য সাবিত্রী মনে মনে কী যেন হিসেব-নিকেশ করেই বলে, পরশু দিন একটুবেশি রাত্তিরে আসতে পারবে?
-বেশি রাত্তির মানে?
–সামনের গির্জের ঘড়িতে ঢং ঢং করে দশটা বাজলেই সরকারবাড়ির বড়কর্তা চলে যান। তুমি তার একটু পরে আসবে।
কী দিবি আমাকে?
সাবিত্রী হেসে বলে, একটা রাত আমার কাছে কাটিয়েই দেখো না কী পাও। যদি লোকসান হয় তাহলে আর কোনদিন এসো না।
–ঠিক আছে, আসব।
–কিন্তু দেখো, কেউ না জানে।
না, না, কেউ জানবে না।
.
হ্যাঁ, সেদিন রাত্রে মল্লিকমশাই গিয়েছিল, না গিয়ে পারেনি। কেউটে সাপকে মানুষ ভয় পায়, কিন্তু তবু কেউটে সাপের খেলা না দেখে কোনো মানুষই থাকতে পারে না। শৈশবে, কৈশোরে, যৌবনে। এমনকি বার্ধক্যেও। সাবিত্রী বারবণিতা। দুর্বল কামার্ত মানুষকে বশ করে, খুশি করেই তার জীবিকা নির্বাহ হয় এবং তা লুকিয়ে চুরিয়ে হাফ গেরস্ত বাড়ির বউ-ঝিয়ের মতো না। প্রকাশ্যেই সে আদিমতম পেশা চালায় কিন্তু তবু কী যেন একটা মোহ, একটা রহস্য ঘিরে আছে এই মেয়েটাকে। সে সবকিছু বিলিয়ে দিয়েও কী যেন নিজের কাছে লুকিয়ে রাখে। বোধহয় সেই রহস্য আবিষ্কারের লোভেই সেদিন রাতের অন্ধকারে মল্লিকমশাই সাবিত্রীর কাছে হাজির হয়।
সাবিত্রী এক গাল খুশির হাসি হেসে বলল, তাহলে মল্লিকমশাই, সত্যি সত্যি আমার সঙ্গে রাত কাটাতে এলে?
মল্লিকমশাইও হেসে জবাব দেয়, কী করব বল? তুই বললে যে আমি গঙ্গায় ডুবে মরতে পারি, তা তো জানিস না।
সাবিত্রী মুখ নাড়িয়ে, ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে, আহা হা! আমার কি ভাগ্যি গো! এমন মিনসে যে এ জগতে আছে, তা যদি আগে জানতাম!
আগে না জানলেও এখন তো জানলি।
যাই হোক, সাবিত্রী অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে ওকে আদর-আপ্যায়ন করল। নিজেকে উজাড় করে দিতেও ত্রুটি রাখল না। কত হাসি-ঠাট্টা গল্প-গুজব হলো। তারপর হঠাৎ সব হাসি-ঠাট্টা বন্ধ করে সাবিত্রী জিজ্ঞেস করল, মল্লিকমশাই, নতুন ব্যবসা করবে?
–কীসের ব্যবসা?
–বিলেতি যন্ত্রপাতির ব্যবসা।
কীসের যন্ত্রপাতি?
–অতশত কি আমি বুঝি? সাবিত্রী একটু থেমে বলে, যদি তোমার গুদাম থাকে। আর গর্ডন সাহেবের অফিসে শনিবারের মধ্যে নগদ লাখ টাকা জমা দিতে পারো, তাহলে বোধহয় বছর বছর লাখ টাকা কামাতে পারবে।
–তোকে কে বলল।
–অত-শত খবরে তোমার কী দরকার? দেরি না করে কালই গর্ডন সাহেবের অফিসে চলে যাও।
নরাত্তম একটু চিন্তিত হয়ে বলে, কালই?
–হ্যাঁ, হ্যাঁ, কালই। দেরি হলে হয়তো ফসকে যাবে কিন্তু দোহাই তোমার, দুনিয়ার কেউ যেন টের না পায়।
ব্যাপারটা একটু খুলেই বল না!
–আগে গর্ডন সাহেবের সঙ্গে দেখা করো। তারপর সব বলব। নরোত্তম একটু ভেবে বলে, কিন্তু গর্ডন সাহেবকে খুঁজে বার করতেও তো দুএকদিন সময় লাগতে পারে।
সাবিত্রী একটু হেসে বলে, ওরে বাপু, গর্ডন সাহেব খুব নামকরা লোক। শুনেছি কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করেন। যে কোনো সাহেবী অফিসে খোঁজ করলেই বোধহয় ওঁর খবর পেয়ে যাবে।