.
যাই হোক, জগদীশ ভটচাজ যখন এই জমিটি পছন্দ করে খোঁজখবর শুরু করেন, তখন উনি জানতে পারেন, সাবিত্রীবালা দাসী নামে এক মহিলা এই জমিটির অর্ধেক অংশ কেনার জন্য জনৈকা মিসেস শিলটনকে পাঁচহাজার টাকা অগ্রিম দিয়েছেন। জগদীশ ভটচাজু যখন ঐ সত্তর বছরের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বুড়ির কাছে হাজির হলেন, তখন উনি বললেন, পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছি ঠিকই এবং রসিদও দিয়েছি কিন্তু কী জন্য ঐ টাকা নিয়েছি তা কিছু লিখিনি।
–কেন মেমসাহেব?
মিসেস শিলটন একটু হেসে বললেন, মিঃ ভট্টাচার্জি, মাই গ্রান্ডফাদার প্রিন্সও ছিলেন, জমিনডারও ছিলেন না, বাট হি ওয়াজ রিয়েলি এ রিচ ম্যান। ধরমতল্লা-লালবাজার অঞ্চলে এগারটা বাড়ির মালিক আমরা। এছাড়া কত জমি আছে আমাদের।…
–এ তো অত্যন্ত খুশির কথা মেমসাহেব।
মেমসাহেব ওঁর কথায় কর্ণপাত না করেই বললেন, ডে আফটার টুমরো মানডে। ঐদিনের মধ্যে যদি মিসেস ডাসি পুরো টাকা পেমেন্ট না করে, তাহলে ঐ জমি অন্য কাউকে বিক্রি করে দেব।
–কিন্তু…
-নো ইফস্ অ্যান্ড বাট মিঃ ভট্টাচার্জি। বুড়ি মাথা নেড়ে বললেন, ওরা যদি অন্য কোথাও জমি কিনতে চায়, ভেরি গুড! নয়তো সঙ্গে সঙ্গে টাকা ফেরত দেব।
-ম্যাডাম, আমি সোমবার সকালে আসব?
-ইয়েস ইউ ক্যান কাম কিন্তু আটটার আগে না। তাছাড়া যে দাম বলেছি, তার এক পয়সা কম দামে আমি বিক্রি করব না অ্যান্ড ইউ উইল হ্যাভ টু পে ইন ক্যাশ।
জগদীশ ভটচাজ সবিনয়ে বললেন, হ্যাঁ, মেমসাহেব, পুরো টাকাই একসঙ্গে দেব কিন্তু দামের ব্যাপারে যদি একটু দয়া করেন..
মিসেস শিলটন মাথা নেড়ে বললেন, নো দয়া-টয়া। বিজনেস ইজ বিজনেস। তারপর একটু হেসে বললেন, তোমার হোল ফ্যামিলিকে আমি তিন দিন ডিনার খাওয়াবো বাট জমির দাম এক পয়সা কম নিতে পারব না।
.
সোমবার সকালে ঘড়িতে আটটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে জগদীশ ভটচাজ নরোত্তমকে নিয়ে মেমসাহেবের বাড়ি হাজির। মেমসাহেব ওদের দেখেই প্রশ্ন করলেন, পুরো টাকা সঙ্গে এনেছ?
জগদীশ ভটচাজ বললেন, হ্যাঁ, মেমসাহেব।
-ভেরি গুড!
মেমসাহেবের দুই ছেলে টাকা গুনে নিতেই মেমসাহেব কাগজে সই করে দিলেন। শুধু তাই না। মেমসাহেব বললেন, ধরমতল্লায় আমরা বড় বড় দুটো বাড়ি বানাচ্ছি। তাই আমরা লালবাজারের সামনের একটা বাড়ি বিক্রি করব।….
নরোত্তম প্রশ্ন করে, কতটা জমি আছে মেমসাহেব?
অর্ধেক জমি কদিন আগেই খান বাহাদুর আবদুল রসিদ চৌধুরীকে বিক্রি করে দিলাম। এখন জমি আছে লিটল ওভার হাফ বিঘা।
নরোত্তম বলে, ইয়েস মেমসাহেব, আপনি দয়া করে ওটাও আমাদের দিন।
–অল রাইট। সামনের সানডে সকালে এইরকম সময় এসো। আমার এক ছেলে ঐ জমি আর বাড়ি তোমাদের দেখিয়ে দেবে।
–ভেরি গুড মেমসাহেব। তবে দয়া করে এই লালবাজারের সম্পত্তির ব্যাপারে এখন আর কারুর সঙ্গে কথা বলবেন না।
–নো, নো; আমি এককথার মানুষ।
.
যাই হোক, মিসেস শিলটনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা দিতেই মেয়েটিকে ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামতে দেখেই নরোত্তম থমকে দাঁড়ায়। খুব চেনা চেনা মনে হয় কিন্তু ঠিক মনে পড়ে না কোথায় দেখা হয়েছে। মেয়েটি পান চিবুতে চিবুতেই এক গাল হাসি হেসে বলে, কিগো মল্লিকবাবু, অমন হাঁ করে তাকিয়ে আছো কেন? যেন চিনতেই পারছে না।
–চিনতে পেরেছি কিন্তু ঠিক…
ওর কথা শুনে মেয়েটি হেসেই আটখান। তারপর নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলে, হা আমার কপাল! আগে ছোট শালী বলে কত ঠাট্টা-ইয়ার্কি করেছ আর এখন…।
মেয়েটির হাব-ভাব, চাল-চলন দেখেই নিজের সম্মান বাঁচাবার জন্য জগদীশ ভট্টাচার্য বেশ খানিকটা দূরে চলে গেছেন। যাই হোক, মেয়েটিকে পুরো কথা শেষ করতে হয় না। এবার নরোত্তম একগাল হাসি হেসে বলে, ও! তুই সাবিত্রী! তা এতো মোটা হয়েছিস যে…
–সরকারবাবুর যত্নে সত্যি একটু মোটা হয়েছি।
-কোন সরকারবাবু?
সাবিত্রীবালা ভুরু নাচিয়ে বলে, তোমার মতোই পাকা রুই। ভবানীপুরে থাকে। তুমি ওকে চেনো না?
নরোত্তম মাথা নেড়ে বলে, না। মল্লিকমশাই সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন করে, তা তুমি এখানে? এই সাত সকালে?
সাবিত্রীবালা চোখ দুটো বড় বড় করে বলে, জমি কিনতে গো! জমি কিনতে। তারপরই একটু চাপা গলায় বলে, পরিবারের লোকজনকে জানাবে না বলে সরকারবাবু জমিটা আমার নামে কিনছে।
-ও!
— তুমি একদিন এসে ছোট শালীর ওখানে।
-আসব কিন্তু তুমি এখন থাকো কোথায়?
-ঐ বৌবাজারের বাড়ির যে-কোনো ঝিকে বললেই দেখিয়ে দেবে। একদিন এসো কিন্তু!
-হ্যাঁ আসব।
সাবিত্রীবালা মিসেস শিলটনের বাড়িতে ঢুকতে গিয়েও পিছিয়ে এসে একটু হেসে নরোত্তমকে বলে, একেবারে খালি হাতে ছোট শালীর কাছে আসতে নেই, তা জানো তো?
নরোত্তম হাসে। মুখে কিছু বলে না।
–তুমি খালি হাতে না এলে আমিও খালি হাতে ফিরিয়ে দেব না। সাবিত্রীবালা মুখ টিপে হেসে বলে, তবে একটু বেলা থাকতে থাকতে এসো।
–আচ্ছা! একটু চাপা হাসি হেসেই নরোত্তম জবাব দেয়।
মাসখানেক পর নরোত্তম মল্লিক সত্যি একদিন সাবিত্রীবালার আস্তানায় হাজির। সাবিত্রীবালা কিছু বলার আগেই মল্লিকমশাই ওর গলায় সাড়ে সাত ভরির একটা হার পরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, কিগো ছোট শালী, পছন্দ হয়েছে?
–কি যে বলল মল্পিকমশাই! তোমার জিনিস আমার পছন্দ হবে না? সাবিত্রীবালা ওর কোলের উপর ঢলে পড়ে বলে, তোমাকে যে কত পছন্দ করি, তা তো তুমি জানো না?