জগদীশ ভটচাজের বিচারবুদ্ধির উপর নরোত্তম মল্লিকের অগাধ আস্থা থাকলেও সুরেন বাঁড়ুজ্যে-আনন্দমোহন বসু রবি ঠাকুর যখন কার্জন সাহেবকে হেনস্তা করার জন্য মেতে উঠেছিলেন, তখন অন্যান্য অনেকের মতো নরোত্তম মল্লিকও ভেবেছিল, হয়তো এ দেশে আর বিলিতি কাপড় বিক্রি হবে না। তবে নরোত্তম মল্লিক মনের কথা মনেই রাখতো। এ আশঙ্কার কথা কাউকে বলতো না। বরং সব সময় মুখে বলতো, অন্য জিনিসপত্তর বিক্রি হবে কি না বলতে পারি না কিন্তু বিলিতি কাপড় বিক্রি হতে বাধ্য। দেশী তাঁতিরা কটা কাপড় বানাবে। মানুষের পেটে ভাত থাক আর নাই থাক, পরনৈ একটুকরো কাপড় চাই-ই।
মুখে এসব কথা বললেও আন্দোলন যখন জমে উঠেছিল, তখন মল্লিমশায়ের মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। তখন জগদীশ ভটচাজ ওঁকে বার বার বলেন, কিছু চিন্তা করো না বাবাজীবন। চাকা ঘুরতে বাধ্য। কিন্তু চাকা যে এমন বনবন করে ঘুরতে শুরু করবে, তা এই বুড়ো ম্যানেজারবাবু স্বপ্নেও ভাবেননি।
আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী ও পরিচিতরা জানলেন, নরোত্তম মল্লিকের ব্যবসা বেশ ভালই চলছে, আয়ও বেড়েছে, কিন্তু ঠিক কতটা ভাল চলছে, তা শুধু জানতেন ঐ বুড়ো ম্যানেজারবাবু আর তার মালিক। একদিন সুযোগ বুঝে জগদীশ ভটচাজ মকিমশাইকে বললেন, যদি কিছু মনে না করো তাহলে একটা কথা বলতাম।
–আপনি আমার পিতৃতুল্য শ্রদ্ধেয় এবং পরম শুভাকাঙ্ক্ষী। আমাকে সব সময় সব কিছু বলার অধিকার তো শুধু আপনারই আছে।
বুড়ো ম্যানেজারবাবু একটু আত্মতৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, হ্যাঁ বাবা, সেই অধিকারেই তোমাকে কটা কথা বলতে চাই।
নরোত্তমের দিকে তাকিয়ে উনি বলেন, দেখো বাবা, কথায় আছে লক্ষ্মী চঞ্চলা। তাছাড়া তুমি দেখেছ, ব্যবসা-বাণিজ্য কখনও ভাল চলে কখনও খারাপ চলে।….
সম্মতিতে নরোত্তম মাথা নাড়ে।
জগদীশ ভটচাজ বলে যান, মা সিদ্ধেশ্বরীর কৃপায় তোমার এখন সুদিন চলছে কিন্তু এমন আমদানি তো চিরকাল থাকতে পারে না বাবা।
সে তো একশ বার।
–দু জাহাজের মাল ছাড়াবার মতো টাকা তো ব্যাঙ্কেই আছে। এছাড়া পূর্ব বাংলার গদিগুলোর টাকা কয়েক দিনের মধ্যেই জমা পড়বে।
–ওখান থেকে কত টাকা আসবে?
-ঠিক মনে নেই; তবে বোধহয় দুলাখ সত্তর হাজার। বুড়ো ম্যানেজারবাবু একটু থেমে বলেন, এইসব বাদ দিয়ে আমার সিন্দুকে আছে তিন লাখ আশি হাজার, আর তোমার বাড়ির সিন্দুকে আছে ঠিক পঁচাত্তর হাজার। তাই আমার দুটো প্রস্তাব আছে।
বলুন।
–সবার আগে লালদিঘি বা বড়বাজারের আশেপাশে তুমি অবিলম্বে কিন্তু সম্পত্তি কিনে রাখো। কারণ চোখের সামনে দেখতে পারছো, ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে জমিজমার দাম বাড়ছে।
নরোত্তম গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনার দ্বিতীয় প্রস্তাবটা কী?
–কোনো একটা ব্যবসা নিয়েই মেতে থাকা ঠিক নয়। শুনেছ তো বোম্বাই রাজ্যের আমেদাবাদ শহরে কাপড়ের কল চালু হচ্ছে বলে বাজারে জোর গুজব। যদি এইসব মিল সত্যি চালু হয়, তাহলে ওদের কাপড়ও তোতা এখানকার বাজারে আসবে।
–আসবে ঠিকই কিন্তু বিলিতি মিলের কাপড়ের সঙ্গে কি পাল্লা দিতে পারবে?
বুড়ো ম্যানেজারবাবু মুখ তুলে একবার চশমাটা ঠিক করে বলেন, বাবাজীবন, খদ্দেররা কখন কী পছন্দ করবে তা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরও আগে থেকে বলতে পারবেন না।
নরোত্তম একটু চিন্তিত হলেও ঈষৎ হাসেন। মাথা নেড়ে বলেন, তা ঠিক।
শুধু তাই না। সব খদ্দেরদেরই তো এক পছন্দ না।
নরোত্তম সব শোনার পর বলে, ভটচাজমশাই, আমাকে দুটো দিন ভাবতে দিন।
–দুদিন কেন, তুমি দশ দিন চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নাও, কিন্তু বেশি দেরি করো না।
হ্যাঁ, ঠিক দুদিন পরই নরোত্তম মল্লিক বুড়ো ম্যানেজারবাবুকে তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল, হ্যাঁ ভটচাজমশাই, আপনার দুটো প্রস্তাবই আমি মেনে নিলাম। সম্পত্তির ব্যাপারে আপনি খোঁজখবর করুন; আমি দেখছি, নতুন ব্যবসা কী করা যায়।
চীনাবাজার ক্যানিং স্ট্রিটের মোড়ের কাছাকাছি যে পাঁচতলা বাড়িটা আজও দক্ষিণের দিকে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে আছে, ঐটাই নরোত্তম মল্লিকের বাড়ি। তবে এই সম্পত্তির পিছনে একটা কাহিনী লুকিয়ে আছে।
.
তখনও চীনাবাজার ক্যানিং স্ট্রিট তৈরি না হলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এই অঞ্চলটি তখন কিছু আর্মেনিয়ান সাহেব বেছে নেন। বহু আর্মেনিয়ান তখন এই অঞ্চলে বসবাসও করেন। এইসব আর্মেনিয়ান সাহেবরা ব্যবসা-বাণিজ্য করলেও বাংলাদেশের মানুষদের তারা হেয় জ্ঞান করতেন না। শুধু তাই নয়। বাংলাদেশের উপর প্রভুত্ব করার বাসনাও এঁদের মনে কোনোদিন আসেনি। নানা কারণে আর্মেনিয়ানরা দুচোখে ইংরেজদের দেখতে পারতেন না। তাই তো সিরাজদ্দৌলা যখন কলকাতা আক্রমণ করে ইংরেজদের হটিয়ে দেন, তখন কলকাতাবাসী আর্মেনিয়ানরা তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেন। দুঃখের বিষয়, পরের বছরই পলাশীর মাঠে সিরাজের পরাজয় হয়। তারপর থেকে বাঙালিদের সঙ্গে সঙ্গে আর্মেনিয়ানদেরও দুর্দিনের শুরু।
ছলে বলে-কলে-কৌশলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর্মেনিয়ানদের ব্যবসা বাণিজ্য কেড়ে নিতে শুরু করে। কিছু কিছু ইংরেজ আবার আক্রোশবশত প্রায় জোর করে ওদের সম্পত্তি দখল করে। আজকের চীনাবাজার ক্যানিং স্ট্রিটের মোড়ের আড়াই বিঘা জমিও এইভাবে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির এক সাহেবের দখলে এসে যায়। তারপর নানা কারণে হাত বদল হতে হতে এই সম্পত্তি চলে আসে কাশিমবাজারের এক দেওয়ানের হাতে এবং এই জমিরই এক অংশে একটা দোতলা বাড়ি তৈরি করেন, কিন্তু বাকি জামিটা বিক্রি করে দেন এক দেন এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সাহেবকে।