আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি বডবউ, যদি এই হতভাগী কোনো অশান্তি করে, তাহলে আমি তাকে ত্যাগ করব।
বড়বউ মানুষটি সত্যি ভাল। বড় শান্তিপ্রিয় আর স্বামীর প্রতি তার অগাধ ভক্তি। কবছর আগে সুহাসিনীকে রক্ষিতা রাখার সময়ও বড়বউ কান্নাকাটি করেছিল। তখন নরোত্তম বলেছিল, বড়বউ, আমি তোমারই থাকব। শুধু সন্ধেবেলায় দুএক ঘণ্টা ওখানে কাটিয়ে চলে আসব।
–তুমি ঠিকই ওখানে রাত কাটাবে।
বড়বউ, আমি জীবনেও ওখানে রাত কাটাবো না। সংসার আর ব্যবসা নষ্ট করার পাত্তর নরোত্তম মল্লিক না।
-এখন তো অনেক কথাই বলবে কিন্তু ঐ ডাইনীর হাতে পড়লে কি এইসব কথা মনে থাকবে?
বড়বউ, ও মাগী যদি বুনো ওল হয়, তাহলে আমিও বাঘা তেঁতুল।
.
নরোত্তম সত্যি কথা রেখেছে। ঝড়-বৃষ্টি-প্লাবন যাই হোক, নরোত্তম মল্লিক তিনশ পঁয়ষট্টি দিন সন্ধের পর সুহাসিনীর কাছে যাবেই। না যেয়ে পাবে না। কিন্তু দুএক ঘণ্টা সোহাগ-ভালবাসার খেলাধুলা করেই বলে, সুহাস, আজ উঠি।
–এখনই? এরই মধ্যে উঠবে?
-হ্যাঁ। নরোত্তম খুব জোরে একবার নিঃশ্বাস ফেলে বলে, কত কাজ ফেলে তোর কাছে আসি জানিস?
-তোমার যে কাজ অনেক, তা আমি ভাল করেই জানি।
গলায় চাদর, পায়ে পাম্প জুতো দিয়ে বারান্দায় পা দিয়েই নরোত্তম সুহাসিনীর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে, এই দুএক ঘণ্টা তোর সঙ্গে খেলাধূলা করে মনটাকে একটু তাজা করে নিয়ে আবার কাজে বসি।
স্বামী রক্ষিতা রেখেছে বলে এখন বড়বউ-এর সত্যি কোনো দুঃখ নই। যদি এই বিষয়ে ওকে কেউ কখন কিছু বলে তাহলে তাকে বড়বউ শুনিয়ে দেয়, তোমাদের গগন ঘোষাল যে তাস খেলেই বউ-ছেলেমেয়েকে পথে বসাচ্ছে,তা দেখতে পাও না? কেন, কেষ্ট ভটচাজ যে গলায় পৈতে দিয়ে সোনাগাছিতে পড়ে থাকে, তাও কি কারুর চোখে পড়ে না? হারু দত্ত তো চব্বিশ ঘণ্টা বোতল নিয়ে পড়ে থাকে। সে বেলায় কারুর মুখে কোনো কথা নেই। যত দোষ এই নন্দ ঘোষের; তাই না?
বড়বউ কোনোমতে একবার নিঃশ্বাস নিয়েই বলে, ওরে বাপু, আমার মতো স্বামী পেতে হলে জম্মো জম্মো তপস্যা করতে হবে।
.
ম্যালকম সাহেবের জাহাজ তখনও বোধহয় খিদিরপুর জাহাজঘাট থেকে ছাড়েনি। নরোত্তম মল্লিক ফুলের তোড়া, এক বোতল শ্যাম্পেন আর একটা বিরাট কেক নিয়ে ডেকস্টার সাহেবের বাংলোয় হাজির-স্যার, ভেরি গুড মর্নিং! আই নরোত্তম মল্লিক।
–আই সি! ডেকস্টার করমর্দনের জন্য ডান হাত বাড়িয়ে দিয়েই একটু হেসে বললেন, আমি বিলাটে বসে টুমার কথা শুনেছে।
–স্যার, সে আপনার কৃপা আর আমার চোদ্দপুরুষের সৌভাগ্য।
–টুমি ইম্পিরিয়্যাল টেক্সটাইলের গ্রেট ডিস্ট্রিবিউটার। টুমার কথা বিলাটের অফিসের সবাই জানে।
–স্যার, আপনারা রাজার জাত। আপনারা দেবতা। তাই আমার মতো কীট পতঙ্গকেও স্নেহ করেন।
মিঃ ডেকস্টার সাহেব আর কথা না বাড়িয়ে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলেন, টেল মি মিঃ মালিক, কীভাবে আমাদের কোম্পানির কাপড় আরো বিক্রি হতে পারে? অ্যান্ড অলসো টেল মি আমি কীভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি?
-স্যার, এককথায় জবাব দেব?
–ইয়েস, ইয়েস।
-স্যার, আমাকে বেঙ্গলের সোল ডিস্ট্রিবিউটার করে দিলেই…
–টুমি পারিবে?
-স্যার, আপনার আশীর্বাদ থাকলে নিশ্চয়ই পিরবো।
লাখখানেক টাকা সিকিউরিটি জমা রাখতে পারবে?
-স্যার, দরকার হলে দুই বউয়ের গহনা বিক্রি করেও ঐ টাকা জমা দেব।
–অল রাইট! ইউ উইল গেট ইট।
.
০৪.
ইংরেজদের দোষ অনেক। ওদের মতো স্বার্থপর, লোভী, রক্ষণশীল ও আত্মকেন্দ্রিক জাতি পৃথিবীতে আর নেই; কিন্তু ওদের একটি গুণ। ওরা কথার খেলাপ করে না। ডেকস্টার সাহেবও তার কথার খেলাপ করেননি। নরোত্তম মল্লিকও তার প্রতিশ্রুতি রেখেছিল। ওর নিষ্ঠা আর উদ্যমে ইম্পিরিয়্যাল টেক্সটাইল কোম্পানির কাপড় ছড়িয়ে পড়ল কটক থেকে তিনসুকিয়া-ডিব্ৰুগড়, পাটনা-মুঙ্গের-ভাগলপুর থেকে চট্টগ্রাম, রাজশাহী রংপুর-বগুড়া থেকে বারাসত-বসিরহাটে বাজারে।
নরোত্তম মল্লিকের বুড়ো ম্যানেজারবাবু জগদীশ ভটচাজ ঠিকই বলেছিলেন, শুধু মানুষের জীবনেই না, ব্যবসা-বাণিজ্যেরও গ্রীষ্ম-বর্ষা শীতবসন্ত আছে। সুরেন বাঁড়ুজ্যের দলবল তো সারাজীবন ধরেই গণ্ডগোল করবে না। দুদিন আগে বা পরে এসব বন্ধ হতে বাধ্য।
জগদীশ ভটচাজ বড়বউয়ের বাপের বাড়ির পুরোহিত এবং ও বাড়ির সবারই খুব শ্রদ্ধার পাত্র। ভদ্রলোকের দুটি ছেলের অকালমৃত্যু হবার পর উনিও আহার-নিদ্রা ত্যাগ করেন। অনেকের অনেক অনুরোধ-উপরোধেও কেনো ফল না হওয়ায় জগদীশবাবুর স্ত্রী ছুটে আসেন নতুন জামাই নরোত্তম মল্লিকের বাড়ি। উনি হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মল্লিক মশায়ের স্ত্রীর দুটি হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, বড় খুকি, তুমিই তো আমাদের বড় মেয়ে মা! তোমার অন্নপ্রাশন, তোমার নামকরণ, হাতে খড়ি থেকে বিয়ে তো উনিই দিয়েছেন। তুমি ওঁকে বাঁচাও মা! তা নইলে চারটি মেয়েকে নিয়ে আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে।
জগদীশ ভটচাজ পুরোহিত হলেও সত্যি বড় খুকিকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং তাইতো বড় খুকীর কান্নাকাটি দেখে উনি শেষ পর্যন্ত মল্লিকবাড়িতে না এসে পারলেন না। পিতৃহীন নরোত্তমও ওঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা-ভক্তি করতে এবং আস্তে আস্তে টুকটাক দায়-দায়িত্ব দিতে শুরু করে। কিছুদিনের মত্যেই নরোত্তম বুঝতে পারে, জগদীশ ভটচাজের শাস্ত্রজ্ঞানের চাইতে ব্যবসায়িক বুদ্ধি অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, মানুষটি যোল আনা সৎ। একেবারে খাঁটি সোনা।