সুহাসিনী অবাক হয়ে বলে, সেকি গো! রাজার জাত হয়েও ওরা মিথ্যে কথা বলে?
নরোত্তম মুখ বিকৃত করে বলে, আমাদের মতো ও শালাদের কি ধম্মো অধম্মে জ্ঞান আছে? হাজার মিথ্যে কথা বলে ও শালারা শুধু কাজ হাসিল করে নেয়।
-তুমি যে আগে ম্যালকম সাহেবের কত পোসংসা করতে?
–গণ্ডগোল শুরু হবার আগে শালার কত বড় বড় কথা! হ্যাঁনো করেঙ্গা, ত্যানো করেঙ্গা! নড়োটম, ডোন্ট বদার! তোমাদের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, তার ষোল আনা ব্যবস্থা আমি করব।
এবার নরোত্তম একটু ম্লান হেসে বলে, যেই গণ্ডগোল থামল, অমনি শালা বেমালুম সব ভুলে গেল।
শুনে সুহাসিনী সত্যি দুঃখিত হয়, হতাশ হয়। তবু জিজ্ঞেস করে, তুমি কিছু বললে?
-কী বলব সুহাস? আমাকে তো ব্যবসা করে খেতে হবে। তারপর খুব জোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, জলে বাস করে কি কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা যায়.?
সুহাসিনী মাথা নেড়ে বলে, সে তো একশবার।
সুহাসিনীর কাছে পরীক্ষায় পাশ হবার পর নরোত্তম মনে মনে খুশি হয়। একটু হাসে। দুহাত দিয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিয়ে বলে, মাগী, তুই যদি আমাকে প্রাণভরে আনন্দ দিতে পারিস, তাহলে ব্যবসা কাকে বলে, তা আমি দেখিয়ে দেব। তুড়ি মেরে লাখ লাখ টাকা আয় করব।
সুহাসিনী একটু ঢল ঢল ভাব করে বলে, তখন কি আর আমাকে ভাল লাগবে? আরো ডাগর-ডোগর কোন মাগী…
নরোত্তম এক গাল হাসি হেসে দুহাত দিয়ে ওর গলা জড়িয়েই টানতে টানতে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলে, তোর চাইতে ডাগর-ডোগর মাগী হয় নাকি?
-সত্যি?
-সত্যি বলছি; তোকে ছুঁয়ে বলছি।
–ছোটবউকে বেশি ভালবাসিস, নাকি আমাকে?
নরোত্তম হো হো করে হেসে উঠে বলে, বউকে আবার কেউ ভালবাসে?
ম্যালকম সাহেব ভাবেন, নরোত্তম মল্লিকের মতো সৎ ও ইংরেজ ভক্ত ব্যবসাদার হয় না; সুহাসিনী ভাবে, ওর মতো বাবু হয় না। কিন্তু নরোত্তম নিজে জানে, সে কী। সে ম্যালকম সাহেবকে বলল, সেকেন্ড ওয়াইফ এর ফার্স্ট সন পুরুষোত্তম ইস্ট বেঙ্গল ঘুরে সব রিপোর্ট এনেছে কিন্তু সাহেব তো জানে না, সেকেন্ড ওয়াইফর কোনো ছেলেমেয়েই এখনও পর্যন্ত হয়নি। হবে কেমন করে? এইতো সেদিন বিয়ে করল। তাছাড়া কদিন ও স্বামীর সোহাগ ভোগ করেছে? শ্বশুরমশায়ের বুড়ো বয়সের কচি মেয়ে। দেখেই মনটা গলে গেল। সঙ্গে দুশ-আড়াইশ ভরি সোনা আর মানিকতলার ঐ দোতলা বাড়ি সমেত সাড়ে পাঁচ বিঘে জমি! এ সুয়োগ ছাড়ার মতো কাঁচা রাত্র নরোত্তম মল্লিক না।
খবরটা শুনে বড়বউএর চোখে জল এসেছিল। নরোত্তম ওর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল, হা ভগবান! তুমি কাঁদছ?
–তুমি আমার সব্বোনাশ করতে যাচ্ছে আর আমি কাঁদব না?
–আমি তোমার সব্বোনাশ করতে যাচ্ছি? নরোত্তম অবাক হয়ে বড়বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলে।
–তুমি আমার ঘরে সতীন আনবে আর….
নরোত্তম হেসেই আটখান। ঐ হাসতে হাসতেই বলে, দূর বোকা! এ হুঁড়িকে বিয়ে করছি তোমার সব্বোনাশের জন্য?
–তবে কি আমার মরার পর সর্গে বাতি দেবার জন্য?
এবার নরোত্তম অত্যন্ত ধীর স্থির হয়ে বলে, শোনো বড়বউ, ঐ বুড়ো নগেনের কচি মেয়েটাকে ঘরে আনছি তোমারই ভালর জন্য।
–ঘরে সতীন আনছ আমারই ভালর জন্য?
নরোত্তম মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ। তারপর একটু থেমে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা বড়বউ, আমার বয়স কত হলো?
পুরো পঞ্চাশ।
-তোমার বয়স কত?
–এই সাঁইত্রিশে পড়েছি।
–কত বছর আমাদের বিয়ে হয়েছে?
–পঁচিশ বছর।
–তোমাকে আমি ভালবাসি না?
–আমি কি তাই বলেছি? বড়বউ মুখ নিচু করে বলে, তোমার সোহাগের দয়াতেই তো আমি শাঁখা-সিঁদুর পরে হাসি মুখে দিন কাটাচ্ছি।
বড়বউ এবার হেসে বলে, আমি তো আমার সইকে বলি, আমি যা স্বামীর সোহাগ পাই, তা বোধহয় কোটি কোটি মেয়ের কপালে জোটে না।
হাসে নরোত্তমও। বলে, তবে? তবে? সেই আমি তোমার সব্বোনাশ করব। এবার ও বড়বউকে বোঝায়, সত্যি বলছি, রাধাকৃষ্ণের নামে দিব্যি করে বলছি, এই কচি মেয়েটাকে ঘরে আনছি তোমার আর তোমার ছেলেমেয়ের মুখ চেয়ে। তুমি তো খাটতে খাটতে মরে গেলে। রাধাকৃষ্ণের সেবা করা থেকে সংসারের হাজার ঝুট-ঝামেলা এক হাতে সামলানো কি সহজ ব্যাপার?
বড়বউ চুপ করে স্বামীর কথা শোনে।
নরোত্তম বলে যায়, এ ছুঁড়ি তোমার দাসী হয়ে সংসারে থাকবে। তোমার সেবা যত্ন কাজকর্ম,
–আহাহা! সে করবে কেন?
না করলে লাথি মেরে দূর করে দেব না! নরোত্তম মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, তাছাড়া আরো ব্যাপার আছে।
–কী?
কলকাতা কী করে বাড়ছে দেখেছ? আমাদের চোদ্দ পুরুষ ভাবেনি, কালীঘাটের চারপাশে, আদি গঙ্গার দুদিকে কোনোদিন ভদ্দরলোক বাস করবে। আর এখন?
বড়বউ ওর কথার কোন মাথামুণ্ডু বোবাঝে না। শুধু হাঁ করে চেয়ে থাকে।
নরোত্তম থামে না, বলে যায়, তোমার ছেলেরা যখন বড় হবে, তখন মানিকতলার ঐ সাড়ে পাঁচ বিঘে জমির দাম হয়তো সাড়ে পাঁচ কোটি টাকায় পৌঁছবে।
নরোত্তম একবার কোনো মতে নিঃশ্বাস নিয়েই বলে, দুচার বছর যেতে না যেতেই হয়তো দেখবে, নতুন কারখানা করার জন্য সাহেবরা ঐ জমি কিনতে আমার বাড়িব দরজায় হুমড়ি খেয়ে পড়বে।
ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়-সম্পত্তির ব্যাপার বড়বউ কিছুই বোঝে না। তবে এটুকু জানে, এই সব ব্যাপারে তার স্বামী কোনো ভুল করার মানুষ না। তবুও বড়বউ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, সবই বুঝলাম কিন্তু সতীন তো সতীনই হবে।