না, মুকুন্দ চুপ করে থাকেনি, থাকবে কেন? বিনু সরকারের কছে তো ও মাথাবিক্রি করেনি! মুকুন্দ ওকে সোজাসুজি বলেছে, চুপ করো, চুপ করো। বেশি ওস্তাদি দেখিও না। তুমি যে বুড়ির কৃপায় এই বাড়িতে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকো, আমি সেই বুড়ির ভাড়াটে। তোমার কৃপায় ব্যবসা করার আগে আমি গলায় দড়ি দিয়ে মরব।
–ওরে যে বুড়ির কথা বলছিস, সে আমার ঠাকুমা; তোর কে?
শুধু মুকুন্দ না, দোকানের দুতিনজন খদ্দেরও ওর কথায় হাসে। হাসবে না কেন? মুকুন্দ ওর কথার জবাব না দিয়ে অন্য খদ্দেরদের দিকে নজর দেয়।
বিনু একটু চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁরে মুকুন্দ, চা দিবি কি?
–যে খদ্দের তিরিশ-বত্রিশটা টাকা ছমাসের মধ্যে দিতে পারে না, তাকে ধারে
ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বিনু বলে, ঠিক আছে। তোকে কি করে টাইট দিতে হয়, তা আমি জানি।
কবে কোনকালে বাড়িটায় গোলাপী রং করা হয়েছিল, তার ঠিক নেই। জল-ঝড় রোদ-বৃষ্টিতে সে রং কবে ধুয়ে-মুছে উঠে গেছে; একটু-আধটু ছাপ লেগে আছে এখানে ওখানে কিন্তু তবু পাড়ার সবাই বলে, গোলাপী বাড়ি। এ পাড়ার পুরনো বাসিন্দারা অবশ্য বলেন সরকারবাড়ি। তবে নামেই সরকারবাড়ি। এ বাড়িতে কত রকমের কত ভাড়াটে যে আছে, তা শুধু ভগবানই জানেন। আড়াই বিঘে জমির উপর বিরাট চারতলা বাড়ির মধ্যে মাত্র দুখানা ঘর এখনও ঐ বুড়ি কামিনীবালা দাসীর দখলে। বাকি সব ঘরদোর ভাড়াটেদের দখলে। এই বুড়ি যেদিন চোখ বন্ধ করবে, সেইদিন এই দুখানা ঘরও কোন ভাগ্যবান ভাড়াটের হাতে চিরকালের জন্য চলে যাবে। ব্যস! সেইদিন থেকে এই বাড়িতে সরকারদের নাম চিরকালের জন্য মুছে যাবে।
বুড়ি কামিনীবালার দিনও শুরু হয় এই সাত সকালেই। ইচ্ছা হয় আরো একটু শুয়ে থাকতে কিন্তু দেরি হলে তো পোড়া কয়লাগুলো বেছে কে যে নিয়ে যাবে তার ঠিক নেই। তাই ঘুম থেকে উঠেই চোখে-মুখে জল দিয়ে একটা ভাঙা কড়া হাতে নিয়ে শিউলিতলায় চলে যান।
এই বিরাট শিউলিগাছের চারপাশে এখন ছাইয়ের পাহাড়। হবে না! যদি তিন শ পঁয়ষট্টি দিন সাত গুষ্টির উনুনের ছাই এখানে ফেলে, তাহলে আর কি হবে? একটুকরো পাথরের উপর আধপোড়া কয়লার টুকরোগুলো ঠুকঠুক করে ঠুকতে ঠুকতে বুড়ি অজান্তেই দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলেন, জম্মো জম্মো ধরে কি পাপই যে করেছিলাম!
সত্যিই তাই। এককালে ঠিক এই জায়গায় কি সুন্দর বাগান ছিল! ছোটকর্তা নিজে কত জায়গা থেকে কত ভাল ভাল ফুলের গাছ এনে এই বাগান সাজিয়েছিলেন। চাঁপা, চামেলি, গন্ধরাজ, গোলাপ! কত রকমের গোলাপ! দেখলে চোখ জুড়িয়ে যেত। তাছাড়া বিলিতি ফুলের কত গাছ ছিল। সন্ধেবেলায় ছাদে গেলেও এইসব ফুলের গন্ধে মন ভরে যেত।
কী একটা শব্দ হতেই কামিনীবালা মুখ তুলে এদিক-ওদিক দেখেন। কাউকে না দেখে দৃষ্টিটা গুটিয়ে আনতে গিয়েও আনতে পারেন না। ডানদিকের ঐ টিনের ঘরখানা দেখেই বুকের ভেতরটা টনটন করে ওঠে। ওখানেই তো ছিল আস্তাবল। বাপরে বাপ! ঘোড়াগুলো কি বিরাট ছিল! দেখতেও কি সুন্দর ছিল। ছোটকর্তার ঘোড়াটা আবার সাদা-কালো রংয়ের ছিল। ওকে দেখতে সব চাইতে ভাল ছিল। তাছাড়া ছুটত কি জোরে! ওর গাড়ি চড়লে যেন মনে হতো উড়ে যাচ্ছি। ছুটবে না? ঘোড়াগুলোর কি যত্ন করা হতো। ছজন তাগড়া পশ্চিমী হিমশিম খেয়ে যেত ওদের দেখাশোনা করতে। ছোটকর্তার গাড়ি চড়ে কামিনীবালা কতদিন কত জায়গা বেড়াতে গিয়েছে। কালীঘাট থেকে আহিরীটোলা-শোভাবাজার-বাগবাজার এমনি বরানগর-দক্ষিণেশ্বরেও গিয়েছেন কতদিন। আর আজ? সেই আস্তাবলের পাশে ছাইয়ের ঢিপির উপর বসে পোড়া কয়লা বাছতে হচ্ছে! একেই বলে, কপালের লিখন না যায় খণ্ডন!
.
কয়লা বাছতে বাছতে বুড়ি কামিনীবালার কত কি মনে পড়ে। রোজ মনে পড়ে। কি ছিল না এই সরকারবাড়িতে? দাস-দাসী ঠাকুর-চাকর দারোয়ান-কোচোয়ান থেকে বাজার সরকার-ম্যানেজারবাবু পর্যন্ত। হাঁচি-কাশি দেবার আগে দাস-দাসীরা ছুটে আসতো। বাড়ির কর্তা-গিন্নিদের হুকুম তামিল করে ওরা কৃতার্থবোধ করতো। বিশেষ করে ছোটকর্তার জন্য ওরা কি না করতে পারতো?
হঠাৎ কামিনীবালার চোখে-মুখে একটু হাসির রেখা ফুটে ওঠে। ছোটকর্তা কি রসিকই ছিলেন! কি আনন্দ আর হৈ-হুল্লোড়ই না করতে পারতেন! অথচ এই মানুষটাকেই ফুলশয্যার রাত্তিরে দেখে কি ভয়ই পেয়েছিলেন!
সেদিন ফুল দিয়ে কি সুন্দর সাজানো হয়েছিল ছোটকর্তার ঘর। যেদিকে তাকাও সেদিকেই শুধু ফুল। আর কি সুন্দর আতরের গন্ধ! আঃ! এখনও যেন নাকে লেগে আছে। বারান্দার বড় ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজতেই বড়গিন্নি মুখ টিপে হাসতে হাসতে বললেন, কি হলো ছোটবউ? কর্তা আসছে না দেখে মন খারাপ লাগছে নাকি?
কিশোরী কামিনীবালা কোনো জবাব দেননি, দিতে পারেননি।
বড়গিন্নি এবার বললেন, ছোটকর্তা হচ্ছেন এ বাড়ির সবচেয়ে রসিক মানুষ। তিনি ইয়ার-দোস্তদের সঙ্গে আড্ডায় একটু আটকে পড়েছেন বলেই..
ঠিক এমন সময় কে যেন ঘরে ঢুকেই বলে গেল, ছোটকর্তা আসছেন। ব্যস! এক মুহূর্তের মধ্যে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। একটু টলতে টলতে মুখে হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকেই ছোটকর্তা বললেন, শুদ্দু তোমার জন্য এই সন্ধেবেলায় ছোট্ট খোকাবাবুর মতো বাড়ি ফিরে এলাম।