–নরোত্তম অতীব ঝানু ব্যবসদার। আন্দোলন শুরু হবার বেশ কিছুদিন আগেই সে সমস্ত গুদাম থেকে পনের আনা কাপড় অন্য জায়গায় সরিয়ে নেয়। তাছাড়া খাতাপত্তরে লিখে রাখে, বিশ-বাইশটা নৌকো বোঝাই কাপড় নানা জেলায় পাঠিয়েছে। তারপর একদিন সুরেন বাঁড়ুজ্যের এক চেলার সঙ্গে দেখা হতেই জিজ্ঞেস করে, কিহে মিত্তির মশাই, তোমরা নাকি আমাদের কাপড়ের ব্যবসা করেতে দেবে না?
–না, বিলেতি কাপড় আর বিক্রি করতে দেওয়া হবে না।
–হবে না মানে?
আমরা সব বিলেতি কাপড় পুড়িয়ে দেব। মিত্তিরমশাই একটু থেমে বলেন, শ্রদ্ধানন্দ পার্কের অনুষ্ঠানের পর স্বেচ্ছাসেবকরা বিলেতি কাপড়ের দোকানে আর গুদামে আগুন দিতে শুরু করবে।
-তাই নাকি?
হ্যাঁ মল্লিকমশাই! নেতারা স্পষ্ট করে কিছু না বললেও স্বেচ্ছাসেবকরা এই রকম ঠিক করেছে।
নরোত্তম বেশ গম্ভীর হয়ে বলে, তাহলে তো যথেষ্ট চিন্তার কথা।
মিত্তিরমশাইয়ের সঙ্গে নরোত্তম মল্লিকের পরিচয় বহুদিনের। তাই মিত্তিরমশাই একটু ভেবে বলেন, শুনছি, কেউ কেউ কাপড়-চোপড় সরিয়ে ফেলছেন। আপনিও সরিয়ে ফেলুন।
-কোথায় সরিয়ে ফেলব বলুন? একি দুএকটা কাপড় যে গিন্নির বাক্স-প্যাটরায় লুকিয়ে রাখব?
–তা ঠিক কিন্তু..
–কিন্তু কী?
–আপনার সব গুদামই তো বড় বড় রাস্তায়। ওগুলো কি বঁচাতে পারবেন? এবার নরোত্তম একটু হেসে বলে, গুদামে আগুন লাগলে আমাকে বিলিতি কাপড়ের ব্যবসা ছেড়ে অন্য ব্যবসা ধরতে হবে। ব্যবসা ছাড়া আমি তো আর কিছু বুঝি না।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, অন্য ব্যবসাই ধরুন।
.
শুধু ইংরেজ সরকার না, ইংরেজ ব্যবসাদারদের সেই মহা দুর্দিনে ম্যালকম সাহেবকে বোকা বানিয়ে নরোত্তম মল্লিক কয়েক দিনের মধ্যেই কয়েক লাখ টাকা কামিয়ে নেয়। ঢাকাই মসলিন, কাশিমবাজার-মুর্শিদাবাদের সিল্ক, তাঁতের কাপড়, লবণ, সোরা, আফিম ইত্যাদি রপ্তানির ব্যবসা বন্ধ হলেও নতুন কিছু বাঙালি ব্যবসাদার ইংরেজদের কৃপায় নতুন করে ধনী হন। নরোত্তম তাঁদেই একজন। বাঙালির সর্বনাশের দিনেই এদের পৌষ মাসের শুরু।
.
হঠাৎ কিছু টাকা পেয়েই কেদার দত্তর মাথায় টাকা ওড়াবার নেশা চেপে ধরল। শুরু হলো দুর্গাপূজা আর কাঙালি ভোজন দিয়ে কিন্তু তারপরই হঠাৎ উনি সঙ্গীতরসিক হয়ে উঠলেন। এমন রসিককে রস-সাগরে ভাসবার জন্য বন্ধুর অভাব হলো না। কেউ খবর দেন, রামপুরের বাঈজী নানু বাঈএর গজল শুনে নাকি জয়পুরের মহারাজা ঠিক করেছেন, জীবনে আর কোনো বাঈজীর গান শুনবেন না। বাগবাজারের নিত্য চাটুজ্যে সে খবর শুনে হেসেই আটখান। কেদার দত্ত অবাক হয়ে বলেন, কিরে নিত্য, হাসছিস কেন?
পিকদানিতে পানের পিক ফেলেই নিত্য চাটুজ্যে বলে, হাসব না? জয়পুরের মহারাজা আবার গানের সমঝদার হলেন কবে?
–তুই কী বলছিস নিত্য? জয়পুরের মহারাজা গানবাজনার সমঝদার না?
–আজ্ঞে না। নিত্য চাটুজ্যে মাথা নেড়ে বলে, জয়পুরের মহারাজা ঘোড়ার ডিম গানবাজনা বোঝেন।
–যাঃ! তাই হয় নাকি?
–ওরে বাপু, জয়পুরের মহারাজা পৃথিবীবিখ্যাত শিকারী কিন্তু…
কেদার দত্ত দুটো চোখে বড় বড় করে বলে, তাই নাকি?
তবে বলছি কী? নিত্য এবার সোজাসুজি কেদার দত্তর চোখের উপর চোখ রেখে বলে, জয়পুরের মহারাজা বছরের ছমাস থাকেন অফ্রিকার জঙ্গলে আর ছমাস থাকেন বিলেতে।
–উনি জয়পুরে থাকেন না?
–দুচার বছর পর দুচারদিনের জন্য আসেন। নিত্য একটু ঢোক গিলে বলে, গানবাজনার ব্যাপারে ওঁর আগ্রহও নেই, সময়ও নেই।
এবার কেদার দত্ত একগাল হাসি হেসে বলে, শালা নুটু ঘোষ গুল মেরেছে।
কেদার দত্তর কথা শুনে নিত্য চাটুজ্যে খুশি হয়। মনে মনে ভাবে, টোপ গেলাতে পেরেছে। কিন্তু মনের কথা মনে রেখেই গম্ভীর হয়ে বলে, যদি সত্যি গজল শুনতে হয়, তাহলে লাহোরের বিখ্যাত বাঈজী রেশোনারা বাঈএর কাছে যেতে হবে।
কেদার দত্ত গানবাজনার কচু বোঝে কিন্তু ম্যালকম সাহেবের কৃপায় ফালতু লাখ খানেক হাতে আসার পর দুচারজন বাঈজীর মজলিসে যাতায়াত করেই এমন ভান দেখায় যে ও গানবাজনার কত বড় সমঝদার। তাই তো রোশোনারা বাঈএর নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এর কথা ওস্তাদ বদরুদ্দীন খাঁ সাহেবের কাছে বহুবার শুনেছি।
নিত্য চাটুজ্যে সঙ্গে সঙ্গে ফোড়ন কাটে, রোশেনারা বাঈএর নাম বড় বড় ওস্তাদদের কাছেই শুনবে। নুটু হারামজাদা ওর নাম জানবে কেমন করে?
নিত্য একটু থেমে একবার আড়চোখে কেদার দত্তকে দেখে নিয়ে বলে, যারা জন্ম থেকে শ্যালদা স্টেশনের কুলিদের ঢোল পিটিয়ে গান করা শুনে আসছে, তারা এইসব বাঈজীদের কদর বুঝবে কেমন করে?
–ঠিক হ্যায়! চলিয়ে লাহোর!
এই করেই কেদার দত্ত শেষ হয়ে যায় কিন্তু নরোত্তম মল্লিক অন্য ধাতু দিয়ে গড়া। ম্যালকম সাহেবকে বোকা বানিয়ে বেশ কয়েক লাখ টাকা পকেটে পুরলেও কাউকে বিশেষ কিছু বুঝতে বা জানতে দিল না। বন্দেমাতরমওয়ালাদের হই-হুঁল্লোড় একটু ঝিমিয়ে পড়ার পর বিলেতি কাপড়ের ব্যবসা আবার চালু হলে বড় গিন্নির অনুরোধে একদিন শনি-সত্যনারায়ণ পূজা হলো, ছোট গিন্নির আবদারে দুই বউকে দুখানা। বেনারসী আর সুহাসিনীর জুটল একটা বিছে হার। সবাইকেই এক কথা বলল নরোত্তম মল্লিক, ভেবেছিলাম আরো কিছু করব কিন্তু তা আর পারলাম না। আমরা যদি ডালে ডালে চলি, তাহলে সাহেবরা চলে পাতায় পাতায়। তাছাড়া শালারা সত্যি কথা বলে না।