কর্নেল লংম্যানের পার্টিতে সব সাহেবের মুখেই এক কথা, এ আলোচনা।
–জাস্ট টেল মি টড, প্রিন্স দোয়ারকা নাথ টেগোরের গ্র্যান্ডসন হয়ে পোয়েট টেগোর কী করে নাখোদা মস্কের মুসলিমদের এমব্রেস করলেন? হুইস্কির গেলাসে চুমুক দেবার আগেই মিঃ ফ্রিম্যান প্রশ্ন করেন গভর্নর জেনারেলের পলিটিক্যাল ডিপার্টমেন্টের অন্যতম কর্ণধার মিঃ টডসনকে।
টডসন উত্তর দেবার আগেই পাশ থেকে মেজর মার্শম্যান চোখ দুটো বড় বড় করে বলেন, নট ওনলি দ্যাট, পোয়েট টেগোর খালি পায় ক্যালকাটার ডার্টি রাস্তায় প্রসেশন করেছেন একদল ছোটলোককে সঙ্গে নিয়ে।
টডসন সাহেব হুইস্কির গেলাসে সামান্য একটু চুমুক দিয়ে গলাটা একটু ভিজিয়ে নিয়েই অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বলেন, পোয়েট টেগোর বিখ্যাত জামিদার বাড়ির লোক হয়ে এইসব কী করে করলেন, তা সত্যি সারপ্রাইজিং….
অ্যান্ড শকিং টু! পাশ থেকে মন্তব্য করলেন এক মেমসাহেব।
-ইয়েস অব কোর্স! মেমসাহেবের দিকে মাথা নেড়ে বললেন টডসন। তারপর একটু থেমে বলেন, ব্যানার্জিকে আই-সি-এস থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। তিনি হয়তো হতাশা বা রাগে অনেক কিছু করতে পারেন কিন্তু হোয়াই ফেমাস ব্যারিস্টার আনন্ডমোহন বাসু বা পোয়েট টেগোর? সব ব্যাপারটাই খুব সিরিয়াসভাবে ভেবে দেখা হচ্ছে।
ওদের গুরুগম্ভীর আলোচনার মাঝখানে আই-সি-এস ক্লিফটন সাহেব যে কখন এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন, তা কেউ খেয়াল করেননি। টডসনের কথা শেষ হতেই উনি বললেন, সব চাইতে বড় কথা, এই লোকগুলো কোন সাহসে ক্রাউনের বিরুদ্ধে শুধু নিজেরাই হই হই করল না, বেঙ্গলের হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কমনম্যানকে খেপিয়ে তুলল?
যাই হোক, অসন্তোষের আগুন তখনও চারদিকে ছড়িয়ে থাকলেও দাউ দাউ করে যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, তা একটু থামতেই তখন আলাপ-আলোচনা, হিসেব নিকেশের পর্ব চলছে সর্বত্র। নরোত্তম মল্লিক একদিন হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ম্যালকম সাহেবের কাছে হাজির।
–হোয়াটস্ দ্য ম্যাটার নড়োটম? এত কাঁদছ কেন?
নরেত্তম মল্লিক সোজা সাহেবের দুটি পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতেই বলল, স্যার, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে।
–এনি বডি ইন ইওর ফ্যামিলি মারা গিয়েছেন?
–স্যার, বাড়ির কেউ মারা গেলে কি এত চোখের জল পড়তো? নরোত্তম অদ্ভুত দুটি চোখে ব্যাকুল দৃষ্টিতে সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার, তার চাইতে অনেক বড় সর্বনাশ হয়ে গেছে।
–আচ্ছা! আচ্ছা! আর কাঁদতে হবে না। কী হয়েছে, তাই বলো।
–স্যার, নরোত্তম এবার উঠে দাঁড়িয়ে দুহাত জোড় করে বলে, স্যার, আমার সেকেন্ড ওয়াইফ-এর ফার্স্ট ছেলে পুরুষোত্তম ইস্ট বেঙ্গলের থেকে আজই…
ম্যালকম সাহেব কোনো মতে হাসি চেপে জিজ্ঞেস করেন, নড়োটম, তোমার কটা ওয়াইফ?
–স্যার, ওনলি টু ওয়াইফ অ্যান্ড…
–অ্যান্ড?
নরোত্তমের ঐ অন্ধকার মুখ মুহূর্তের জন্য একবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলে স্যার, অ্যান্ড সুহাসিনী দাসী মাই কেপ্ট!
–আই সি! ম্যালকম সাহেব এবার আর না হেসে পারেন না :
–স্যার, সুহাসিনী ভেরি বিউটিফুল; ভেরি গুড গার্ল। ও না থাকলে আজ আমি ঠিকই আত্মহত্যা করতাম।
-তাই নাকি?
-হ্যাঁ স্যার!
ম্যালকম সাহেব আবার একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, আই অ্যাম হ্যাঁপি টু নো। ইট। তুমি আত্মহত্যা করলে তো আমি হাজার সমস্যায় পড়তাম।
সাহেব এখানেই থামেন না। বলেন, আমি বেশ বুঝতে পারছি, মহিলাটি সত্যি ভাল এবং বুদ্ধিমতী।
সাহেবের কথা শুনে নরোত্তম মনে মনে আত্মহারা হয়ে যায়। বলে, স্যার, সুহাসিনী ইজ টনিক, সুহাসিনী ইজ গন্ধরাজ!
ওর কথা শুনে সাহেব হো হো করে হেসে ওঠেন।
না, নরোত্তম মল্লিক তার আসল উদ্দেশ্য ভুলে যায় না। বলে, স্যার, সেকেন্ড ওয়াইফএর ফার্স্টসনের কাছে যখন শুনতে পেলাম, এই হতচ্ছাড়া বন্দেমাতরমওয়ালারা আমার কাপড় বোঝাই দশ-বারোটা নৌকা শুধু পদ্মা আর মেঘনাতেই ডুবিয়ে দিয়েছে…
রিয়েলি?
নরোত্তম আবার কাঁদতে শুরু করে।
–ডোন্ট ক্রাই। কী কী ক্ষতি হয়েছে, তাই বলো।
নরোত্তম ধুতির এক কোনা দিয়ে চোখের জল মুছে বলে, স্যার, বন্দেমাতরমওয়ালারা ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট-ময়মনসিং আর বরিশালের পনের আনা কাপড়ের দোকান পুড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া যশোর-খুলনা রংপুর-বগুড়া রাজশাহীতে দোকান পোড়ানো ছাড়া দোকানদারদের খুব মারধর করেছে।…
ম্যালকম সাহেব অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বলেন, হ্যাঁ, মিঃ টডসন বলছিলেন, পলিটিক্যাল ডিপার্টমেন্টেও এই ধরনের খবর এসেছে।
-স্যার, এদিকে কলকাতা আর ব্যারাকপুরের দুটো গুদামই তো…
লুঠ হয়েছে তো?
-হ্যাঁ, স্যার।
–ইয়েস দ্যাট আই নো। ম্যালকম সাহেব এবার পাইপ ধরিয়ে একটা টান দিয়ে যেন আপনমনে বলেন, দ্য হোল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কোলাপসড়!
-স্যার, আমাকে কিছু বললেন?
-ইয়েস নড়োটম, তোমার যেখানে যা ক্ষতি হয়েছে, তার পুরো হিসেব আমাকে চটপট দাও। কেডার ডাট্টা অ্যান্ড আদার ডিস্ট্রিবিউটরদেরও বলল, আমাকে পুরো হিসেব দিতে।
–ইয়েস স্যার! তবে আমার মতো ক্ষতি আর কারুর হয়নি।
দ্যাট আই নো।
.
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে সত্যি বহু বিলেতি কাপড়ের ব্যবসাদারদের ক্ষতি হয়। বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে হাটেবাজারে যেসব দোকানদাররা বিলেতি কাপড় বিক্রি করতেন, তাঁদের অধিকাংশ দোকানই আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কিছু কিছু জায়গায় লুটপাটও হয়। ক্ষতি হয়েছিল নরোত্তম মল্লিকেরও; তবে সে ক্ষতি অতি সামান্যই।