ম্যালকম সাহেব পাইপ ধরাতে ধরাতে বলেন, ইয়েস ইয়েস, সে হোয়াট ইউ লাইক।
–স্যার! নরোত্তম মুখ কাঁচুমাচু করে শুরু করেন, আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, এই আন্দোলনের দ্বারা বিলেতি কাপড় বিক্রি বন্ধ করা যাবে না কিন্তু এতগুলো বিখ্যাত লোক যখন উঠে পড়ে লেগেছেন, তখন কিছু গণ্ডগোল হবেই।
অব কোর্স! ম্যালকম এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে বলেন, গণ্ডগোল যে হবে, সে বিষয়ে শুধু আমরা ইংরেজ ব্যবসাদাররা না, গভর্নমেন্টের মনেও কোনো সন্দেহ নেই।
তাই বলছিলাম স্যার, আমাদের যদি কোনো ক্ষতি হয় তাহলে দয়া করে ক্ষতিপুরণের ব্যবস্থা করবেন নয়ত….
ম্যালকম সাহেব আর কথা না বাড়িয়ে বলেন, লুক হিয়ার নড়োটম, তোমাকে আমি সোজাসুজি বলে দিচ্ছি, এই মুভমেন্টের জন্য তোমাদের যে ক্ষতি হবে, তার মোল আনা ক্ষতিপূরণ তোমরা পাবে।
সাহেব পাইপে একটা টান দিয়ে বলে যান, শুধু তাই নয়, তোমরা যাতে আরো ভাল করে ব্যবসা করতে পারো, তারজন্যও শুধু আমরাই না, স্বয়ং গভর্নর জেনারেল এবং ভাইসরয়ও চেষ্টা করবেন।
মুগ্ধ বিস্ময়ে নরোত্তম হতবাক হয়ে সাহেবের দিকে তাকান। তারপর কোনমতে বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে বলেন, স্যার, এত বড় সৌভ্যাগের কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।
ম্যালকম সাহেব যেন আপন মনেই বিড়বিড় করেন, এই মুভমেন্ট যারা করছে, তাদের উচিত শিক্ষা দেবার জন্যই তোমাদের সাহায্য করতেই হবে।
সাহেবকে শত কোটি প্রণাম জানিয়ে নরোত্তম মল্লিক বিদায় নেন এবং মনে মনে বলেন, এই শালা ইংরেজ জাতটা হচ্ছে হাড় কেল্পনের জাত। ওয়ান পাইস ফাদার-মাদার না, একেবারে গ্র্যান্ড-ফাদার-গ্র্যান্ড-মাদার! এই শালা ম্যালকমকে কত বছর ধরে বলছি, স্যার, আপনি আমাদের বাপ-মা, দয়া করে একটু কমিশন বাড়িয়ে দিন, কিন্তু না, কিছুতেই করল না। কখনও বলেছে, হা দেখছি; আবার কখনও বলেছে, বিলেতে চিঠি লিখেছি….
এই সব কথা ভাবতে ভাবতে ঘোড়ার গাড়ি বৌবাজারে পৌঁছে যায়। বাহান্ন বছরের নরোত্তম মল্লিক আনন্দে খুশিতে প্রায় বাচ্চা ছেলের মতো সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে সুহাসিনীর ঘরে ঢুকেই ওকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে নাচতে শুরু করেন। সুহাসিনী কোনো মতে পানের পিক গিলে বলে, কিরে মিনসে, কার সব্বোনাশ করে আবার কী সম্পত্তি করলি?
নরোত্তম এবার নাচ থামিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে এক গাল হাসি হেসে বলেন, ওরে মাগী, এবার আর কোনো বোস-ঘোষ-মিত্তির বা বাঁড়ুজ্যে-চাটুজ্যে না, একেবারে ম্যালকম সাহবকে কুপোকাত করব।
–ওরে মিনসে, তুই কি আজ দিনে-দুপুরে গাঁজা টেনেছিস?
না নরোত্তম মল্লিক গঞ্জিকা সেবন করে আসেনি। এবার ও গম্ভীর হয়ে বলে, সত্যি, সুহাস, ম্যালকম সাহেএমন প্যাঁচে পড়েছে যে…
সাহেব পাচে পড়ল কেমন করে। ওরা রাজার জাত। ওরা কি কাঁচা কাজ করে?
সুহাসিনীকে নরোত্তম সত্যি ভালবাসে। ভালবাসবে না কেন? সারাটা দিন সংসার ধর্ম টাকাকড়ি ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে কত ঝামেলা যে ওকে সহ্য করতে হয়, তার ঠিকঠিকানা নেই। এক একদিন অসহ্য মনে হয়। মুহূর্তের জন্য মনে হয়, সব ছেড়েছুঁড়ে কোথাও পালিয়ে যায়। কিন্তু না, নরোত্তম পালিয়ে যায় না, যেতে পারে না। সন্ধ্যের পর গদি থেকে বেরিয়ে হাজার দুঃশ্চিন্তার বোঝা মাথায় নিয়ে ও প্রায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো চলে আসে বৌবাজার।
তারপর?
এক ঝি পাখার বাতাস করে, আরেক ঝি পা ধুইয়ে শুকনো গামছা দিয়ে মুছিয়ে দিতে না দিতেই সুহাসিনী এক গেলাস শরবত আর এক থালা জলখাবার নিয়ে হাজির হয়।
–আজ আর কিছু খাবো না।
-কেন?
–ইচ্ছে করছে না।
–ইচ্ছে করছে না বললেই কি হয়? সুহাসিনী পাশে বসে নিজে হাতে পাখার বাতাস করতে করতে বলে, সেই সাত সকালে বড়গিন্নির হাতে দুমুঠো নাকে-মুখে দিয়েই তো গদিতে গিয়েছ। তারপর সারাদিন তো আর মুখে কিছু দাওনি।
নরোত্তম তবু বলেন, সত্যি সুহাস, এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।
–তাই কি হয়, এই পরিশ্রমের পর পেটে কিছু না পড়লে শরীরটা থাকবে কী করে?
এইটুকু বলেই সুহাসিনী চুপ করে থাকে না। নিজে হাতে ওঁকে খাইয়ে দেয়। নরোত্তম ওকে বাধা দেন না; বরং খুশি হন।
তারপর সুহাসিনীর বুকের মধ্যে আত্মসমর্পণ করে উনি সব দুঃশ্চিন্তার হাত থেকে মুক্তি পান।
.
সমগ্র বাংলাদেশের উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেল। হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগরের ধার, চট্টগ্রামের অরণ্য-পর্বত থেকে বীরভূমের লাল মাটি আর বাঁকুড়ার কাকুরে মাটিতে হঠাৎ এক চাঞ্চল্যর ঢেউ অবাক করে দিল শুধু কার্জন সাহেবকে না, বিলেতের ভারত-ভাগ্য বিধাতাদেরও। সবাই বিস্মিত হতম্ভব! সমস্ত বঞ্চনাকে যারা ভাগ্যের পরিহাস বলে স্বীকার করে নিয়েছিল, সেই বঞ্চিত বুভুক্ষু গভীর নিদ্রামগ্ন বাঙালির ঘুম ভাঙল কী করে? শুধু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদেরই না, সমস্ত ইংরেজকে যে বাঙালি জাতি দেবদূত বলে তাদের প্রত্যেকটি হুকুম নিঃশব্দে তামিল করেছে, সেই বাঙালিই কি মন্ত্রবলে তাদের উপেক্ষা করল? কী আছে ঐ বন্দেমাতরম কথাটির মধ্যে?
ম্যালকম সাহেব তো ভেবেই পেলেন না, বিলেতে তৈরি অত সুন্দর কাপড়ের পরিবর্তে বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে তৈরি মোটা কাপড়গুলো ব্যবহার করার কী আনন্দ বা সার্থকতা থাকতে পারে?