পলাশীর যুদ্ধের পর কয়েক বছরের মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল। হবে না? সিরাজের মৃত্যুর পর মীরজাফর ও মীরকাশিম নিজেদের গদি বাঁচবার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তাদের কিছু কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মচারীর হাতে পঞ্চাশ লক্ষ পাউন্ডের সমতুল্য অর্থ ও সোনা রূপা তুলে দেন। নানা নথিপত্র বিচার-বিবেচনা করে ঐতিহাসিকরা বলেছেন, পলাশীর যুদ্ধের পরবর্তী তেইশ বছরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা থেকে তিন শ আশি লক্ষ পাউন্ড ইংল্যান্ডে নিয়ে যায়।
দ্বিতীয় পর্বে শুরু হলো জুয়াচুরি। বার্ষিক তিন হাজার টাকা দেবার বিনিময়ে বাংলার গভর্নব যুবরাজ সুজা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে যে শুল্ক মকুব করেছিলেন, তার মোল আনা অপব্যবহার করে কোম্পানি যে কত লক্ষ লক্ষ টাকার শুল্ক ফাঁকি দেয়, তার ঠিকঠিকানা নেই।
তৃতীয় পর্বে শুরু হলো বাংলার তাতিদের উপর অত্যাচার। তাঁতিদের মারধর করে কোম্পানির সাহেবরা আসল দামের চাইতেও কম দামে মাল কিনতে শুরু করে। ফলে বাংলার অসংখ্য তাতি তত বোনা ছেড়ে মাঠে নামলেন লাঙল নিয়ে।
তারপর আরো কত কী হলো! বাংলার সমস্ত ঐশ্বর্য লুণ্ঠন শেষ হতে না হতেই ম্যাঞ্চেস্টারে কাপড়ের কল চালু হলো। একদিন যে বাংলার কাপড় পৃথিবীর দিকে দিকে রপ্তানি হতো, সেই বাংলাদেশেই জাহাজ বোঝাই বিলেতি কাপড় আমদানি শুরু হলো।
ফোর্ট উইলিয়ামের প্রথম গভর্নর জেনারেল হেস্টিংস চলে গেলেন ১৭৮৫এর শুরুতেই অস্থায়ী গভর্নর জেনারেল হলেন স্যার জন ম্যাকফারসন। স্যার জনের পরেই এলেন কর্নওয়ালিশ। সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ইনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তও চালু করলেন এবং শুরু হলো জমিদারদের দ্বারা প্রজা শোষণ। দিকে ব্যবসা বাণিজ্য শেষ, তার উপর এই শোষণ! বাংলা ও বাঙালিকে শেষ করার কী অপূর্ব ব্যবস্থা!
এই পরিস্থিতিতেও শুরু হলো নতুন ব্যবসা বাণিজ্য বিলিতি জিনিস বিক্রি। জাহাজ বোঝাই জিনিসপত্র আসতো কলকাতার গঙ্গায়। স্ট্রান্ড রোডের ধারের বড় বড় গুদামে রাখা হতো সে সব জিনিসপত্র। তারপর ঠেলা আর নৌকা বোঝাই করে সে সব জিনিসপত্র ছড়িয়ে পড়তে শহর কলকাতার বাজারে আর গ্রামবাংলার অসংখ্য গঞ্জে।
পরনে আট হাতি মোটা ধুতি, গায় ফতুয়া, গলায় চাদর ও হাতে ছাতি নিয়ে নরোত্তম মল্লিক ঘরে ঢুকেই করজোড়ে নমস্কার করতেই ম্যালকম সাহেব এক গাল হাসি হেসে। বললেন, গুড মর্নিং নড়োটম!
–ভেরি গুড মর্নিং স্যার!
সামনের চেয়ার দেখিয়ে সাহেব বললেন, সিট ডাউন নড়োটম।
কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে নরোত্তম বলেন, নো সিট ডাউন স্যার।
-হোয়াই? কেনো বসিবে না?
-স্যার, আপনি মালিক, আপনি রাজার জাত। আপনার সামনে কি আমার মতো অধম বসতে পারে।
ম্যালকম সাহেব হো হো করে হেসে ওঠেন কিন্তু মনে মনে খুশি হন। তারপর নরোত্তমের দিকে তাকিয়ে একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, ইফ আই অর্ডার ইউ–যদি হামি টুমাকে অর্ডার কড়ি, টাহা হইলে বসিবে?
লজ্জা, ভক্তি, শ্রদ্ধায় নরোত্তম আর সাহেবের দিকে মুখ তুলে তাকাতে পারেন না। মুখ নিচু করে বলেন, স্যার হুকুম করলে কুকুরের পেচ্ছাব পর্যন্ত খেতে পাবি।
ম্যালকম সাহেব মুখ বিকৃতি করে বলেন, ও! ডোন্ট বি সিলি। নাউ টেক ইওর সিট। জরুরি কথা আছে।
সত্যি, জরুরি কথার জন্যই সাহেব ওকে তলব করেছিলেন। ব্যবসা-বাণিজ্য বেশ ভালই চলছিল কিন্তু লর্ড কার্জন বঙ্গবঙ্গের সিদ্ধান্ত নিতেই এক দল শিক্ষিত ভদ্রলোক সাধারণ মানুষকে এমন খেপিয়ে তুলতে শুরু করেছে যে এম্পায়ার টেক্সটাইল কোম্পানির লন্ডন অফিস পর্যন্ত চিন্তায় পড়েছে। ওরা কদিন আগেই ম্যালকম সাহেবকে তার পাঠিয়ে বলেছে, এই সঙ্কটের মোকাবিলা কীভাবে করা যায় সত্বর জানাও।
নড়োটম।
ইয়েস স্যার!
–স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, ফেমাস ব্যারিস্টার মিস্টার আনন্ডমোহন বাসু থেকে শুরু করে ফেমাস পোয়েট টেগোর পর্যন্ত এক জোট হয়ে ঠিক করেছেন, আমাদের দেশে টৈরি কাপড় টোমাডের পরতে দেবেন না।
নরোত্তম মল্লিক অধোবদনে সাহেবের কথা শোনেন।
ম্যালকম সাহেব অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে বলেন, হোয়াট ইজ ইওর ইনফরমেশন? ও সম্পর্কে তোমরা ব্যবসাদাররা কিছু শুনেছ?
লজ্জায় দুঃখে নরোত্তম মুখ নিচু করেই উত্তর দেন, হ্যাঁ স্যার, শুনেছি বৈকি! উনি এক মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, স্যার, আমি তো স্বপ্নেও ভাবতে পারছি না, এই সব বিলেতফেরত শিক্ষিত ও বনেদী পরিবারের মানুষরা কী করে এই রকম ভুল কাজ করতে পারেন।
–আই অলসনা কান্ট ড্রিম। আমি ভাবতে পারি না বাট দে আর ডুয়িং।
-ইয়েস স্যার।
–এই বিষয়ে তোমরা নিজেদের মধ্যে–আই মিন তোমরা যারা বিলাইতি কাপড়ের মেন ডিস্ট্রিবিউটার–কোনো আলাপ-আলোচনা করেছ?
এবার নরোত্তম মুখ তুলে বলেন, হ্যাঁ, স্যার, করেছি বৈকি।
ম্যালকম সাহেব মুখে কিছু বললেও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকান।
-স্যার, আমার আর কেদার দত্তর ধারণা এইসব ফালতু হইচই করে বিলিতি কাপড় বিক্রি বন্ধ করা যাবে না।
-হোয়াই?
নরোত্তম মল্লিক এক গাল হাসি হেসে বলেন, স্যার, বিলিতি কাপড় ছাড়া লোকে পরবে কী? দেশি কাপড় কি শহুরে মানুষ পরে?
দ্যাটস রাইট বাট এতগুলো ফেমাস লোক যখন মুভমেন্ট করছেন, তখন আমাদের ক্ষতি হতে তত বাধ্য।
মুহূর্তের মধ্যে ঝানু ব্যবসাদার নরোত্তম মল্লিক মনে মনে হিসেব-নিকেশ করে বলেন, তবে স্যার, যদি অনুমতি করেন, তাহলে দুএকটা কথা বলি।