এতক্ষণ পর ভাইদের মধ্যে প্রথম কথা বলেন মেজকর্তা। উনি একটু খুশির হাসি হেসে বললেন, বাবা যে আমাদের এক একজনের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা রেখে গেছেন, তা তো আগে জানতে পারিনি।
বড়বাবুগস্ত্রীর হয়ে বললেন, আরো দুএকটা খবর আছে, যা আমরা আগে জানতে পারিনি।
সেজবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সেও কি বিষয়-সম্পত্তির…।
বড়বাবু ওঁর কথায় কান না দিয়েই বলেন, খবরগুলি গুরুতর। ইম্পিরিয়্যাল ব্যাঙ্কের অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজার সাহেবকে বাবা লিখিতভবে নির্দেশ দিয়ে গেছেন, তার অ্যাকাউন্টের পাঁচ লাখ টাকা থেকে এক লাখ পাবেন মানিকতলার জগত্তারিণী দাসী, এক লাখ টাকা দিতে হবে মিসেস উইলিয়ামকে…
দুতিন ভাই প্রায় একসঙ্গেই প্রশ্ন করেন, এরা কারা?
–আগে আমাকে সব কথা বলতে দাও; তারপর তোমরা প্রশ্ন করো।
না, কোনো ভাইয়ের মুখে আর একটি কথা নেই।
বড়বাবু বিন্দুমাত্র ভাবাবেগ প্রকাশ না করে বলে যান, ঐ জগত্তারিণী দাসীর দুই কন্যার বিবাহের জন্য এক লাখ দিতে হবে এবং বাকি দুলাখ মানিকতলার জমিতে জগত্তারিণী দাসীর বাড়ি তৈরি হবে।
এইবার উনি ভাইদের দিকে তাকিয়ে বলেন, বলল, কী জানতে চাও।
মেজবাবু আর সেজবাবু প্রায় একসঙ্গে প্রশ্ন করেন, কে এই জগত্তারিণী দাসী?
ন’বাবু একটু মুখ টিপে হেসে প্রায় একসঙ্গেই প্রশ্ন করেন, নিশ্চয়ই আমাদের খুব আপনজন!
বড়বাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, জগত্তারিণী দাসী বাবার রক্ষিতা ছিলেন এবং দুই কন্যার জন্মদাতাও তিনি।
বড় ভাইয়ের কথা শুনে অন্য ভাইদের হৃৎপিণ্ডের ওঠানমা বন্ধ হয়ে যায় কয়েক মুহূর্তের জন্য। কারুর মুখ থেকে কোনো কথা বেরোয় না। তারপর মেজবাবু জিজ্ঞেস করেন, আপনি এই জগত্তারিণী দাসীর খবর আগেই জানতেন?
বড়বাবু জবাব দেন, হ্যাঁ, জানতাম।
–এ খবর তো আগে কোনোদিন আমাদের বলেননি।
–বাবার রক্ষিতাকে নিয়ে আলোচনা করার রুচি হয়নি। উনি একটু থেমে বলেন, বাবা নিজের জীবিতকালেই যদি এইসব টাকা ওদের দিয়ে যেতেন, তাহলে আজকে আমাকে এই অপ্রিয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হতো না।
এবার ন’বাবু হঠাৎ প্রশ্ন করেন, আচ্ছা বড়দা, এই ইংরেজ মহিলাটিও কি পিতৃদেবের রক্ষিতা ছিলেন?
–আংশিক।
বড়বাবুর উত্তর শুনে সব ভাইরা একসঙ্গে হেসে ওঠেন। ওঁদের হাসির জন্য বড়বাবুও একটু না হেসে পারেন না।
সেজবাবু চাপা হাসি হেসে জিজ্ঞেস করেন, আংশিক মানে?
–কেন তোমরা আমাকে এইসব অপ্রিয় প্রশ্ন করছ? দুদিন পর তোমরা নিজেরাই সবকিছু জানতে পারবে। বড়বাবু খুব জোরে একবার নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, ওসব কথা বাদ দাও। এখন তোমরা আমাকে একটি কথার জবাব দাও।
সবাই গম্ভীর হয়ে বড়বাবুর দিকে তাকান।
–এখন সব চাইতে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি যৌথ পরিবার থাকবো নাকিআলাদা হবো? আমরা সবাই মিলেমিশে ব্যবসা-বাণিজ্য চালাবো, নাকি তাও ভাগবাটোয়ারা করে আলাদা করে নেব?
নবাবু প্রশ্ন করেন, হঠাৎ আলাদা হবার কথা বলছেন কেন? কেউ কি আলাদা হতে চেয়েছে?
আরো দুএক ভাই বললেন, আলাদা হবার কথা উঠছে কেন?
বড়বাবু বললেন, আমি তোমাদের আলাদা হতে বলছি না বা আমি নিজে আলাদা হতে চাইছি না। উনি একটু থেমে বললেন, তবে একথা আমাদের ভুললে চলবে না যে বাবা আর বেঁচে নেই। তিনি থাকতে সবকিছুই তার ইচ্ছামত হয়েছে এবং আমরা মেনে নিতেও বাধ্য হয়েছি।
একই নিঃশ্বাসে উনি সঙ্গে সঙ্গে বলেন, অবশ্য একথা হাজার বার মানতে হবে পিতৃদেব সংসার ও ব্যবসার অকল্পনীয় উন্নতি করছেন।
মেজবাবু বললেন, সে তো একশবার।
–তবুও তো তোমরা স্বীকার করবে বাবার বহু কাজ আমরা মেনে নিতে পারিনি। তখন বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছি কিন্তু এখন তো আর সেই বাধ্যতা থাকছে না।
অন্য সব ভাই চুপচাপ করে থাকলেও ছোটবাবু বললেন, বাবা যখন নেই তখন আপনিই সব সিদ্ধান্ত নেবেন এবং আপনার সিধান্ত মেনে নিতে তো আমাদের আপত্তি থাকতে পারে না।
–তুমি আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও সবাই মানবে কেন? প্রত্যেকেরই তো নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ইচ্ছা-অনিচ্ছা থাকে। তাছাড়া এ বিষয়ে বৌমাদের সঙ্গেও তোমাদের পরামর্শ করা উচিত।
সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে বড়বাবু মনে মনে একটু হেসে বলেন, আজ এখনই তোমাদের সিদ্ধান্ত নিতে বলছি না কিন্তু সাত দিন, দশ দিন বা বড়জোর মাসখানেকের। মধ্যে একটা কিছু সিদ্ধান্ত আমাদের নিতেই হবে। সব শেষে উনি বললেন, আর হ্যাঁ, ঐ পাঁচ লাখ টাকা বাবা কাকে কীভাবে দিতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন, তা দশ জনে জানলে বোধহয় আমাদেরই ক্ষতি হবে।
৩-৪. সব শুরুরই শেষ
সব শুরুরই শেষ আছে; কিন্তু সব শেষেরও তো শুরু আছে।
কলকাতার মাটিতে জোব চার্নক পা দেবার সময় ধনী ব্যবসায়ী হিসেবে বসাক আর শেঠদের খ্যাতি থাকলেও বাংলাদেশে সচ্ছল ব্যবসায়ীর সংখ্যা নিতান্ত কম ছিল না। পলাশীর যুদ্ধের আগে বাংলাদেশের হিন্দু, মুসলমান ও আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ীরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও আরব, পারস্য, তুরস্ক ও তিব্বতে সুতি ও সিল্কের কাপড়, চিনি, লবণ, সোরা ও আফিম বিক্রি করে শত শত কোটি টাকা আয় করতেন। ঢাকাই মসলিনের চাহিদা তো তখন সারা পৃথিবীতে। মুর্শিদাবাদ সিল্কের জন্য হাহাকার করতেন সমগ্র ইউরোপ ও জাপানের বিত্তবান নারী-পুরুষরা। ইউরোপের ব্যবসায়ীরা বাংলা থেকে কোটি কোটি টাকার সুতি ও সিল্কের কাপড় কিনে জাহাজ বোঝাই করে নিয়ে যেতেন নানা দেশে। নবাব আলিবর্দি খার রাজস্ব বিভাগের হিসেবের খাতায় দেখা যায় শুধু মুর্শিদাবাদ থেকে যে সিল্কের কাপড় ইউরোপে রপ্তানি হয়, তার জন্য শুল্ক বাবদ আয় হয় সত্তর লক্ষ টাকা বাংলার ঘরে ঘরে তখন সত্যি গোলা ভরা ধান।