-কেন?
–ওর যে রূপ-গুণের কথা শুনেছিলাম, তার চাইতে হাজার গুণ ভাল ওকে দেখতে। গুণের কথা আর কী বলব সই?
মানদাসুন্দরী চোখ বড় বড় করে বলেন, ও এত সুন্দরী?
–হ্যাঁ সই। লক্ষ্মী-সরস্বতী তো দূরের কথা, স্বয়ং মা দুর্গাও ওর রূপের কাছে হার মানবেন। কুসুমকুমারী ঠোঁট উল্টে বলেন, আর কি গড়ন ভাই! সারা অঙ্গ দিয়ে মধু ঝরছে।
-তারপর?
–তারপর আবার কী? ওকে দেখে তো কর্তার মাথা ঘুরে গেল।
–ইস! কী কেলেঙ্কারি!
কুসুমকুমারী সইয়ের মুখে পান দিয়ে নিজেও একটা পান মুখে নেন। তারপর দোক্তা মুখে দিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে বলেন, অত রূপ-গুণ থাকলে কী হয়, শুধু অভাবের জন্য মেয়েটার বিয়ে দিতে পারছিল না ওর বাপ!
-তাই নাকি?
–গরিব না হলে কি ওর বাপ কর্তার খপ্পরে পড়তো?
–তা ঠিক। মানদাসুন্দরী একবার পানের পিক ফেলে একটু মুখ টিপে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করেন, তারপর কর্তা কী করে মেয়েটিকে হাত করলেন?
-কর্তা ওর বাপকে বললেন, কোনো চিন্তা করবেন না। আপনার এ মেয়ের সঙ্গে আমি ডেপুটির বিয়ে দেব; তবে থাকে পশ্চিমে। হয়তো মেয়েকে ওখানে নিয়ে গিয়েই বিয়ে দিতে হবে কিন্তু তার জন্য ঘাবড়াবেন না। আমি বিয়ের সব খরচপত্তর দেব। আর আপনার দ্বিতীয়া কন্যাকে আমার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেব। তার জন্যও আপনাকে এক পয়সা ব্যয় করতে হবে না।
মানদাসুন্দরী অতি দুঃখেও একটু না হেসে পারেন না। জিজ্ঞেস করেন, তারপর কর্তা কী করে মেয়েটিকে হাত করলেন?
কুসুমকুমারী একটু ম্লান হাসি হেসে বলেন, আগে নিজের ছেলের বিয়ের দিন-টিন স্থির করে আশীর্বাদপর্ব চুকিয়ে ওর বাপের হাতে কয়েক হাজার টাকা খুঁজে দিয়ে একদিন ঐ বড় মেয়েটাকে নিয়ে পশ্চিমে রওনা হলেন পাত্রপক্ষকে দেখাবার কথা বলে।
-তারপর?
আর তারপর! কর্তা একা ফিরে এসে বললেন, মেয়েটিকে ওদের এতই পছন্দ হলো যে তিন দিনের মধ্যে গোধূলি লগ্নে বিয়ে হয়ে গেল। তবে হ্যাঁ, ওরা আপনাদের জন্য প্রণামী পাঠিয়েছে।
এইবার মানদাসুন্দরী একটু ম্লান হেসে হাসি হেসে বলেন, এই বলে বুঝি ওই গরিব লোকটার হাতে আরো কিছু তুলে দিলেন?
–তবে কী?
মেয়েটি তারপর আর বাপের বাড়ি আসেননি?
কুসুমকুমারী এবার একটু জোরেই হাসেন। বলেন, কর্তার কথা আর বলো না। এই ঘটনার মাসখানেক পরই ওদের বাড়িতে একটা তার এলো, হরিদ্বারের গঙ্গায় স্নান করতে গিয়ে মেয়েটি হঠাৎ ডুবে মারা গেছে। ব্যস! আর কী চাই?
.
সারা ভবানীপুর পাড়ার কেউ বনবিহারী দত্তর ছেলেদের নাম জানতেন না। জানার দরকারও হতো না। দুনিয়ার সবাই ওঁদের জানতেন দত্তবাড়ির বড়বাবু, মেজবাবু, সেজবাবু, ন’বাবু ও ছোটবাবু বলে। এমন কি বাড়ির বউ-ঝিরাও ঐ বলেই কথাবার্তা বলতেন। অপরিচিতদের কানে খটকা লাগতো। অনেকে ঠাট্টা করে বলাবলি করতেন, ও বাড়ির বউ-ঝিরাও বোধহয় বনবিহারী দত্তর কোনো না কোনো কোম্পানির কর্মচারী। পাড়ার দুচারজন রসিক লোক পিতৃভক্ত এই পাঁচ ভাইকে পঞ্চপাণ্ডব বলে উল্লেখ করতেন। এই পিতৃভক্ত পুত্ররা যেভাবে পিতৃশ্রাদ্ধ করেছিলেন, তা দেখে অনেকেই অবাক হয়ে যান। শোনা যায়, একশ একজন অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও পণ্ডিত ব্রাহ্মণ গীতা পাঠ করেছিলেন। নিয়মভঙ্গের দিন কত হাজার লোককে যে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল, তার হিসেব নাকি কেউ জানতেন না।
যাই হোক, এই সব মিটে যাবার কয়েক দিন পর বড়বাবু একদিন সকালে সব ভাইদের ডেকে বললেন, পিতৃদেব ঠাকুর্দার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে কী পেয়েছিলেন, তা তোমরা সবাই খুব ভাল করেই জানো এবং আমাদের পিতৃদেব আমাদের জন্য কী রেখে গেছেন, তা তোমাদের বলি…
চার ভাই অবাক হয়ে বড় ভাইয়ের দিকে তাকান।
অনেক দলিল-দস্তাবেজ ও কাগজপত্তরের মাঝখানে বসে বড়বাবু চোখে চশমা, লাগিয়ে একটা কাগজ তুলে নিয়ে একবার ভাল করে চোখ বুলিয়ে ভাইদের দিকে। তাকিয়ে বললেন, আমাদের চারটি কোম্পানির খবর তোমরা সবাই জানো এবং মোটামুটিভাবে প্রত্যেকটি কোম্পানি থেকেই বছরের সব খরচ-খরচা বাদ দিয়ে চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা লাভ হয়। অর্থাৎ বছরে পৌনে দুলাখ।
সবাই চুপ।
বড়বাবু এবার অন্য একটা কাগজ হাতে তুলে নিয়ে বলেন, অগ্রদ্বীপের সম্পত্তির কথা বাদ দিয়ে পিতৃদেব স্থাবর যে সম্পত্তি রেখে গেছেন তা হচ্ছে, ভবানীপুরের এই বাড়ি, স্ট্রান্ড রোডে আড়াই বিঘে জমির উপর গুদামঘর, মানিকতলায় সাড়ে তিন একর জমি, মধুপুর-গিরিডিতে মোট সাত বিঘে জমি ও ছোট্ট ছোট্ট দুটি বাড়ি।
বড়বাবু এবার হাতের কাগজ থেকে মুখ তুলে বলেন, এইসব সম্পত্তির দলিল ও খাজনা-ট্যাক্সের রসিদ সবই ঠিক আছে। তবে কাগজপত্র ঘেঁটে দেখছি, পুরীতে দুবিঘে জমির উপর একটি দোতলা বাড়ির জন্যও বাবা একজনকে বছর পাঁচেক আগে পাঁচ হাজার এক টাকা অগ্রিম দেন কিন্তু সেই অগ্রিম দেবার রসিদ ছাড়া আর কোনো কাগজপত্র এখনও পর্যন্ত পাইনি। এ বিষয়ে একটু খোঁজখবর নিতে হবে; কারণ বাবা অগ্রিম দিয়ে চুপ করে বসে থাকার মানুষ ছিলেন না।
চার ভাই নীরবেই সম্মতিতে মাথা নাড়েন।
বড়বাবু এবার অন্য একটি কাগজ হাতে তুলে নিয়ে বলেন, আমাদের চারটি কোম্পানির নামে ইম্পিরিয়্যাল ব্যাঙ্কে যে চারটি অ্যাকাউন্ট আছে, তাতে এখন মোট জমা আছে সড়ে তিন লাখের কিছু বেশি। এই ইম্পিরিয়্যাল ব্যাঙ্কেই বাবার নিজস্ব অ্যাকাউন্টে আছে পাঁচ লাখ এবং আমাদের প্রত্যেক ভাইয়ের নামে বাবা রেখে গেছেন পঞ্চাশ হাজার করে।