হ্যাঁ, সেই উৎসবের দিনে ওঁরা সবাই রায়বাহদুরের বাড়িতে এসেছিলেন।
ঐ উৎসবের বাড়িতেই লাটসাহেব এ কথা-সে কথার পর বনবিহারী দত্তকে বললেন, বাই দ্য ওয়ে রয় বাহাদুর, আপনি তো তিন জেনারেসন ধরে বহু বিখ্যাত ব্রিটিশ এঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির মেসিনারি বিক্রি করছেন আর এখানে নিজেও অনেক জিনিস তৈরি করছেন।
–আপনার আশীর্বাদে ইয়েস ইওর একসেলেনসি!
–আজ গভর্নমেন্ট হাউসে একটা মিটিং-এ ঠিক হয়েছে আমরা অল ওভার বেঙ্গল কয়েকটা ব্রিজ তৈরি করব।
–ইওর একসেলেনসি, ভেরি গুড ডিসিসন।
লাটসাহেব একটু মাথা দুলিয়ে বললেন, সো আই ওয়াজ ওয়ান্ডারিং আপনার মত এক্সপিরিয়েন্সড ফার্ম যদি দুচারটে ব্রিজ তৈরি করে তাহলে তো ভালই হয়। হিজ একসেলেনসি এক মুহূর্তের জন্য একটু থেমে বলেন, সোকন্ড কন্ট্রাকটরকে দিয়ে আমি এই ব্রিজ তৈরি করাতে চাই না।
সকৃতজ্ঞ রায়বাহাদুর বনবিহারী দত্ত একগাল হাসি হেসে সবিনয়ে নিবেদন করলেন, হিজ একসেলেনসি দয়া করে যে দায়িত্ব দেবেন, তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করব।
বনবিহারী দত্ত রায়বাহাদুর খেতাব পাবার পর সাহেবি পোশাক পরে মোটরগাড়ি চড়ে সাহেব-সুবা রাজা-মহারাজাদের পার্টিতে যেতেন বলে কত লোক হাসাহাসি করেছে। প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে অনেকেই বলাবলি করতেন, এবার চালিয়াতি করেই বনবিহারী দত্ত সব উড়িয়ে দেবেন। কিন্তু ওঁরা জানতেন না, বনবিহারী দত্তর রক্তের মধ্যে ব্যবসা ছিল। উনি শয়নে-স্বপনেও শুধু ব্যবসার কথাই ভাবতেন।
উনি মারা যাবার পর ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয়-সম্পত্তির খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ওঁর সম্পর্কে নানা কাহিনী সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ বলতেন, উনি ফুলশয্যার রাত্তিরে স্ত্রীকে নিয়ে শুতে যাবার আগে বিয়ে-বৌভাতের খরচপত্তর হিসেব করতে বসেছিলেন।
এ কাহিনীর সত্যাসত্য কেউ সঠিকভাবে বলতে না পারলেও একথা সর্বজনবিদিত ছিল যে হিসেব নিকেশ না করে বোধহয় বনবিহারী দত্ত হাঁচি-কাশিও দিতেন না।
একবার নাকি ওঁর স্ত্রী মানদাসুন্দরী স্বামীর কাছে আর্জি পেশ করেছিলেন, ভগবান তো আপনাকে এত দিচ্ছেন, বাড়িতে একটা রাধাকৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করুন না।
বনবিহারী বুঝি জবাব দিয়েছিলেন, গিন্নি, বাড়িতে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলে আমার শুধু খরচই বাড়বে, কোনো আয় হবে না। তার চাইতে দুর্গাপূজা করা। এমন দুপাঁচশ লোককে নেমন্তন্ন করা যাবে, যারা আমার ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারেও সাহায্য করবেন।
–আপনি জানেন না, আমাদের চোদ্দপুরুষ রাধাকৃষ্ণের চরণাশ্রিত? মানদাসুন্দরী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, আমি কি শক্তিপূজা কবার কথা বলতে পারি?
.
সরকারবাড়ির বড় গিন্নিমা কুসুমকুমারী দাসী ছিলেন মানদাসুন্দরীর সই। খুব ভাব ছিল দুজনের। রোজ একবার করে দুজনের দেখা না হলে রাত্তিরে কারুরই ঘুম আসতো না। সে সময় একবার নাকি দুতিনটে খারাপ গ্রহ-নক্ষত্রের যোগাযোগে সারা বাংলাদেশে প্রবল বন্যা হয়েছিল। সাহেব-মেমসাহেবরা পর্যন্ত চৌরঙ্গিতে নৌকো চড়ে যাতায়াত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিশেষ করে একদিন এমন দুর্যোগ দেখা দিল যে সেদিন দত্তবাড়ি থেকে সরকারবাড়ি যাওয়া অসম্ভব অকল্পনীয়। মাঝরাত্তিরে মানদাসুন্দরী হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বড়, ছেলের কাছে এসে বললেন, বড়, আজ সারাদিনে একবারও তোমার সইমার মুখ দেখতে পাইনি বাবা। তুমি যেভাবেই পারো আমাকে এবার ওর কাছে নিয়ে চলো।
মানদাসুন্দরীর মৃত্যুর বহু বছর পর কুসুমকুমারী নাতি-নাতনীদের কাছে সে রাত্তিরের গল্প করতে করতে একগাল হাসি হেসে বলেন, জানিস সে রাত্তিরে সই কীভাবে আমার কাছে এসেছিল?
কীভাবে?
সরকারবাড়ির বড় গিন্নি হাসতে হাসতে বলেন, দত্তবাড়ির পশ্চিমী দারোয়ানদের ঘর থেকে একটা চৌকি বার করে তার উপর সইকে বসিয়ে ছাতি নিয়ে ওর ছেলে পাশে বসেছিল। তারপর চারজন পশ্চিমী লোক সে চৌকি মাথায় করে নিয়ে এসেছিল এ বাড়িতে।
-বলো কী ঠাকুমা?
-ওরে হ্যাঁ, ঐভাবেই ও এসেছিল। আমাকে না দেখলে কি ওর ঘুম হতো? নাকি দেখে আমি ঘুমুতে পারতাম? কুসুমকুমারী লুকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, শুধু সই এর জন্যই তো আমি মরতে পারিনি।
নাতি-নাতনীদের মধ্যে কে একজন বলল, তার মানে?
না, কুসুমকুমারী ওদের কিছু বলেননি। বলতে পারেননি। হাজার হোক স্বামীর নিন্দা কি করা যায়? কথায় বলে, পতি দেবতা। স্ত্রীলোকের সাক্ষাৎ ভগবান! তার নিন্দা করলে জিভ খসে পড়বে না! উনি কোনোদিন কাউকেই কিছু বলেননি। পতিদেবতার নিন্দা নয়, নিজের মনের দুঃখের কথা উনি শুধু সইকেই বলতেন। না বলে থাকতে পারেননি। মানুষ তার সুখ-দুঃখের কথা কাউকে না কাউকেই বলবেই। না বলে থাকতে পারে না।
-জানিস সই, দুঃখের কথা তোমাকে ছাড়া আর কাকে বলব? ফিসফিস করে কুসুমকুমারী বলেন, কর্তা কাশীতে যে বাঈজীকে নিয়ে থাকেন, সে আসলে আমার বড় বউয়ের বড় বোন।
–সেকি সই? মানদাসুন্দরী চমকে ওঠেন।
তবে আর বলছি কী সই? কুসুমসুন্দরী একবার বুকভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, আমি আর কর্তা গিয়েছিলাম শ্রীরামপুরে বড়ছেলের জন্য মেয়ে দেখতে। মেয়েটির রূপ গুণের কথা অনেক দিন ধরেই আমরা শুনেছিলাম কিন্তু মেয়েটিকে দেখে, তার কথাবার্তা শুনে আমরা একেবারে থ!