ছোট কাকার গল্প শুনতে কণিকার ভালই লাগে। কত কি জানা যায়! তাছাড়া বৃদ্ধ হলেও বেশ আধুনিক মনের মানুষ।
অঘোরনাথ বলে যান, ঐ বৃদ্ধের মধ্যে একটা সাধনা ছিল, প্রতিজ্ঞা ছিল। ক্লাইভ স্ট্রিটের একটা ছোট্ট দোকান থেকে উনি কি বিরাট ব্যবসা গড়ে তোলেন, তা ভাবলেও অবাক হতে হয়।
–উনি নাকি লেখাপড়া বিশেষ জানতেন না? এতক্ষণ পর কণিকা প্রশ্ন করেন।
–আগে উনি সত্যি বিশেষ লেখাপড়া জানতেন না। এমন কি ইংরেজিতে নিজের নাম পর্যন্ত সই করতে পারতেন না কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য একটু গুছিয়ে নেবার পর উনি ছোটদাদুর কাছে পড়াশুনা শুরু করেন।
দুজনেই কফির পেয়ালায় শেষ চুমুক দেন। কণিকা জানতে চান, পড়াশুনা শুরু করেন মানে?
অঘোরনাথ একটু হেসে বলেন, সে এক মজার ঘটনা। ছোটদাদুই একদিন ওঁকে বলেন, বনবিহারী, ব্যবসা-বাণিজ্য তো ভালই করছ কিন্তু একটু লেখাপড়া না শিখলে যে বেশি উন্নতি করতে পারবে না।
কণিকা আবার একটু জিজ্ঞেস করেন, শুনেছি, ওঁর নাকি বাতিক ছিল সবাইকে লেখাপড়া শেখানো?
–বাতিক মানে? প্রচণ্ড বাতিক।
–আপনাদের এক বুড়ো চাকরকেও নাকি উনি নিজে পড়িয়ে গ্র্যাজুয়েট…
অঘোরনাথ একটু হেসে বলেন, না, না, তুমি একটু ভুল শুনেছ। রামদুলাল বলে আমাদের বাড়ির এক চাকরকে ছোট দাদু নিজে পড়িয়ে ম্যাট্রিক পাস করান। তারপর ওকে ইউনিভারসিটিতে একটা চাকরি দেবার জন্য ছোটদাদু স্যার আশুতোষকে ধরেন।
উনি এক নিঃশ্বাসে বলে যান, স্যার আশুতোষ ওকে চাকরি দিয়েছিলেন এই শর্তে যে ও গ্র্যাজুয়েট হবে।…
–রামদুলাল কি শেষ পর্যন্ত গ্র্যাজুয়েট হন?
–রামদুলাল বোধহয় একবারেই ইন্টারমিডিয়েট পাস করে কিন্তু একবার বা দুবার ফেল করার পর বি. এ. পাস করে।
বনবিহারী দত্তকেও উনি ম্যাট্রিক বা…
কণিকাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই উনি বলেন, না, না, উনি ম্যাট্রিক পাস করেননি, গ্র্যাজুয়েট ও হননি; তবে উনি রোজ সকালে ছোটদাদুর কাছে পড়তে আসতেন।…
–তখন ওঁর কত বয়স?
হবে চল্লিশ-পঞ্চাশ।
–আচ্ছা!
অঘোরনাথ একটু থেমে বলেন, উনি শেষ পর্যন্ত এত ভাল ইংরেজি শিখেছিলেন যে বড় বড় সাহেবরাও অবাক হয়ে যেতেন। শেক্সপিয়র-মিলটন-বায়রন তো ওঁর কণ্ঠস্থ ছিল।
-বলেন কী?
–বলছি তো ছোট মা, ওঁর মধ্যে একটা নিষ্ঠা ছিল, সততা ছিল, যা ওকে বড় করেছিল। অঘোরনাথ একটা চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেন, শুধু বদমাইশি আর চালিয়াতি করে ওঁর নাতি-নাতনীরা সব ধ্বংস করে দিল।
–ওঁর ছেলেমেয়েরা ব্যবসা নষ্ট করেননি?
না, না, ওঁর ছেলেরা কিছু নষ্ট করেননি; ওঁর নাতি-নাতিরাই সব উড়িয়ে দিল।
তবে যে শুনি, বনবিহারী দত্তর এক ছেলে বাঈজীবাড়িতেই পড়ে থাকতেন।
অঘোরনাথ একটু মুচকি হেসে বলেন, শ্মশানে যাঁরা পড়ে থাকেন, নেশা করেন, তাঁদের মধ্যে দুএকজন তো তান্ত্রিকও থাকতে পারেন।
-সে তো একশবার।
বনবিহারী দত্তর ছোট ছেলে শুধু বাঈজীবাড়ি যেতেন না, বাড়িতেও বাঈজী নিয়ে আসতেন; তবে তিনি চরিত্রহীন ছিলেন না। গান-বাজনার জন্যই বাঈজী বাড়ি যেতেন, গান-বাজনা শোনার জন্যই তাদের মজলিশ বসতো এই দত্তবাড়ির ছাদে।
উনি একটু থেমে বলেন, তবে বনবিহারী দত্তর ছেলেরা ইন্টারেস্টিং মানুষ ছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের পক্ষে যত সর্বনাশেরই হোক, বনবিহারী দত্ত এই যুদ্ধের কৃপায় রাজা হয়ে যান। শুধু অর্থই না, যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় নানা জিনিসপত্র নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরবরাহ করার জন্য বড় বড় ইংরেজ আমলাদের বিশেষ প্রশংসা অর্জন করেন। বনবিহারী সম্রাটের যুদ্ধ তহবিলেও মোটা টাকা দান করেছিলেন বলে স্বয়ং লাটসাহেব ওঁকে ধন্যবাদ জানান। পরের বছরই উনি রায়বাহাদুর খেতাব পান।
এই রায়বাহাদুর খেতাব পাবার পরই উনি একটু বদলে যান। ঘোড়ার গাড়ি ছেড়ে নতুন মোটরগাড়ি কিনলেন। ছেলেদের উপর ব্যবসা-বাণিজ্যের ভার দিয়ে নিজে সাহেব সুবাদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করলেন। শুধু তাই নয়। দেশি পোশাক ছেড়ে সাহেবি পোশাক ধরলেন। তবে হ্যাঁ, ছেলেরা কে কী করছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে কোথায় কী হচ্ছে, তার উপর যোল আনা নজর রাখতেন রায়বাহাদুর বনবিহারী দত্ত।
বনবিহারী পাঁচটি ছেলে ও পাঁচটি মেয়ে ছিল। এ ছাড়া তিনটি সন্তান শৈশবেই মারা যায়। পাঁচটি মেয়ের ও তিনটি ছেলের বিয়ে আগেই দিয়েছিলেন। রায়বাহাদুর খেতাব পাবার পর চতুর্থ পুত্রের বিয়ে দেন। সে এক এলাহি ব্যাপার! বিয়েব এক মাস আগে ইম্পিরিয়্যাল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের সব চাইতে দামী রং দিয়ে পুরো বাড়ি নতুন করে বং করা হলো। পাড়ার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ছাড়াও কলকাতা শহরের প্রত্যেকটি গণ্যমান্যবরেণ্য ব্যক্তিকে নিমন্ত্রণ করলেন রায়বাহাদুর। তারপর বিয়েব কদিন আগে রটে। গেল, স্বয়ং লাটসাহেব আসবেন বৌভাতের নেমন্তন্ন খেতে। পরের দিন থেকেই পুলিশ আর কর্পোরেশনেব বড়কর্তাদের আসা-যাওয়া শুরু হলো। লাটসাহেবের সম্মানে ভবানীপুরের সুন্দর রাস্তাগুলোকে আরো সুন্দর ঝকঝকে করে তুলল কর্পোরেশনের লোকজন। লাটসাহেবের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর কোচবিহার কাশিমবাজার-নাটোর-দীঘাপতি প্রভৃতির রাজারাও ঠিক করলেন, রায়বাহাদুরের পুত্রের বৌভাতে উপস্থিত থাকবেন।