বাট….
দামোদর সোজাসুজি বললেন, স্যার নো বাট। আই গুড ম্যান, ইউ মাই গড।
সাহেব একবার ওর দিকে তাকিয়ে একটু ভাবেন। তারপর একটু হেসে বললেন, অল রাইট ডামোডর, ইউ স্টার্ট বিজনেস, হাম মদত কোরবে।
সেই শুরু! দামোদর তার নিষ্ঠা, সততা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের দ্বারা এক বিরাট সম্ভাবনার ভিত্তি রচনা করেন। দামোদরের এগারটি সন্তানের মধ্যে মাত্র তিনটি পুত্র ছিল। এবং এই তিনটির মধ্যে একটি পুত্র কৈশোরেই মারা যায়। নিজের সংসারে দায়-দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও ইনি বিডন স্ট্রিটের সাড়ে তিন কাঠা জমির উপর দোতলা বাড়ি তৈরি করেন। শুধু তাই নয়। অগ্রদ্বীপেও বিরাট পাকাবাড়ি তৈরি করে দেন। উনি ষে পূজামণ্ডপ তৈরি করেন, সেখানেই পরবর্তীকালে পোস্ট অফিস হয়। পোস্ট অফিস নতুন বাড়িতে উঠে যাবার পর এই পূজামণ্ডপকে গুদাম হিসেবে ভাড়া দেওয়া শুরু হয়।
দুঃখের বিষয়, দামোদরের মৃত্যুর বছরখানেকের মধ্যেই তাঁর দুই ছেলের বিবাদ চরমে ওঠে। বিশিষ্ট উকিল ও প্রতিবেশী অমৃতবাবুর মধ্যস্থতায় সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়। এই ভাগাভাগির ফলে বনবিহারী পান ক্লাইভ স্ট্রিটের ব্যবসা আর মাত্র পনের হাজার টাকা। বাকি সব-স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি পান তার ভাই রাসবিহারী।
বনবিহারীও তার বাবার মতোই সৎ, নিষ্ঠাবান ও সর্বোপরি অত্যন্ত পরিশ্রমী ছিলেন। বড় বড় কোম্পানির সাহেবরা সত্যি ওঁকে খুব পছন্দ করতেন।
স্বামী ও ছেলেমেয়ে বেরিয়ে যাবার পরও কণিকা দেবীকে সংসারের টুকিটাকি কাজে ঘণ্টাখানেক ব্যস্ত থাকতে হয়। অঘোরনাথ হঠাৎ ভিতর এসে বলেন, কী ছোট মা, তুমি খাওয়া-দাওয়া করবে না?
–হ্যাঁ ছোটকাকা, এখনি খাবো; আপনি বসুন। কণিকা এবার রান্নাঘরের দিকে মুখ করে বললেন, সরলা আমাকে খেতে দাও।
অঘোর বাঁড়ুজ্যে অত্যন্ত নিয়মকানুন মেনে চলেন। পৌনে আটটা থেকে আটটার মধ্যে উনি ব্রেকফার্স্ট খান। ব্রেকফার্স্ট মানে অবশ্য এক গেলাস দুধ আর একটা শশা। শশা না পাওয়া গেলে অন্য কোনো ফল। তবে অন্য কিছু নয়। কখনই নয়।
অঘোরনাথের দীর্ঘ কর্মজীবন কেটেছে বাংলার বাইরে। মিলিটারি অ্যাকাউন্টসএর কৃপায় উনি ঘুরছেন পেশোয়ার থেকে এলাহাবাদের মধ্যবর্তী এলাকায়। পেশোয়ার, আম্বালা, মীরাট, দিল্লি প্রভৃতি শহরে। এরই মধ্যেই কয়েক বছর কাটিয়েছেন পুনা আর বোম্বতে। উনি বাংলাদেশের বাঙালিদের মতো শুধু অসুখ বিসুখ হলেই ফল খান না। উত্তর ভারতের লোকজনদের মতো প্রতিদিন ওঁর ফল খাওয়া চাই-ই। নীতীশ জানেন, ছোটকাকা ফল খেতে ভালবাসেন; তাই উনি অফিস থেকে ফেরার সময় প্রায় নিয়মিত কিছু ফল কিনে আনেন। তবে অঘোরনাথের পাল্লায় পড়ে এখন এ বাড়ির সবাইকে রোজ একটু-আধটু ফল খেতে হয়। নীতীশ অফিস বেরুবার আগেই উনি কণিকা দেবীকে রলেন, ছোট, মা নীতুর ব্রিফকেসে একটা আপেল দিয়েছ?
-হ্যাঁ ছোটকাকা, দিয়েছি।
নীতু, বাবা আপেলটা খেতে ভুলে যাস না।
না, না ভুলব না ছোটকাকা।
কণিকা একবার স্বামীর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বলেন, জানেন ছোটকাকা, ও মাঝে মাঝেই ফল খেতে ভুলে যায়।
কদাচিৎ কখনও ভুলে…
না, নীতীশকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই অঘোরনাথ বলেন, না বাবা, ভুলে যাস না। রোজ একটু আধটু ফল খেলে দেখবি, অসুখ-বিসুখ হবে না।
অবশ্য নীতীশের ছেলেমেয়ে-সন্দীপন আর শর্বরীর মাথায় ওদের ছোটদাদু ঢুকিয়েছেন, ফল খেলে চেহারা সুন্দর হয়। ফল আর দুধ খাওয়ার জন্যই তো মুনি ঋষিদের দেখতে এত সুন্দর ছিল। প্রত্যেক মানুষের জীবনেই একটা বয়স আসে যখন সে সুন্দর হতে চায়, আরো সুন্দর হতে চায়। এ বাড়িতে একমাত্র কণিকাই ফল খেতে পছন্দ করেন না কিন্তু অঘোরনাথের পাল্লায় পড়ে তারও মুক্তি নেই।
কণিকার ব্রেকফাস্টের সময় অঘোরনাথ রোজ ওঁর পাশে বসবেন এবং কিছু ফল ওঁকে খেতেই হবে। শর্বরী বাড়ি থাকলে ও মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলে, জানো দাদু, তুমি সামনে না থাকলে মা কোনো ফল মুখে দেয় না।
কণিকা হাসিমুখেই মেয়েকে বকুনি দেন, তুই চুপ কর বাঁদর মেয়েএবার উনি গম্ভীর হয়ে বলেন, তোর দাদুকেই জিজ্ঞেস কর, আমি ওঁর কোনো কথা অমান্য করি কি না।
অঘোরনাথ দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলেন, আমি কার দলে যাই? একদিকে আমার মা, অন্যদিকে আমার চিরজীবনের জীবনসঙ্গিনী!
সে যাই হোক, কণিকার ব্রেকফার্স্ট করার সময় অঘোরনাথ রোজ এক কাপ কফি খান এবং দুজনে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করেন। নানা বিষয়ে ওঁদের কথাবার্তা হয়! অঘোরনাথের ছেলেবেলায় গল্প, কর্মজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা, নীতীশের ছাত্রজীবনের কাহিনী। আরো কত কি! কখনও কখনও সন্দীপন আর শর্বরীকে নিয়েই ওঁদের কত আলোচনা হয়।
আজ ডাইনিং টেবিলে বসেই অঘোরনাথ বললেন, জানো ছোট মা, দত্তদের বাড়িটা ভাঙছে দেখে মনে মনে খুশিই হচ্ছি।
-খুশি! কণিকা অবাক হয়ে বলেন।
-দেখ ছোট মা, এ সংসারের সবকিছুরই কারণ থাকে। মানুষের উন্নতিরও যেমন কারণ থাকে, অবনতিরও কারণ থাকে।
এবার কণিকা মাথা নেড়ে বলেন, সে তো বটেই!
-কনবিহারী দত্ত আমার জন্মের বহু আগেই এই বাড়ি তৈরি করেন। শুনেছিলাম, সরকারদের বাড়ি আর এঁদের বাড়ি একই এঞ্জিনিয়ার তৈরি করেন। আমি ছোটবেলায় বনবিহারী দত্তকে বেশ বৃদ্ধই দেখেছি কিন্তু ঐ বয়সেও উনি যা পরিশ্রম করতেন তা তুমি ভাবতে পারবে না।