মুকুন্দ কথার মাঝখানেই কথা বলে, শুনেছি, আপনার শ্বশুর এখানে থাকতেন না
আমার বিয়ের দশ বারো বছর আগেই ঠাকুরের স্ত্রীবিয়োগ হয়। কামিনীবান এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটু চাপা গলায় বলেন, উনি গলায় দড়ি দিয়ে মারা যান বুঝলি?
-তাই নাকি?
–হ্যাঁরে, মনের দুঃখে উনি গলায় দড়ি দেন।
মুকুন্দ মুখে কিছু বলে না। শুধু ওঁর দিকে তাকিয়ে থাকে।
কামিনীবালা মুখ নেড়ে চোখ বড় বড় করে বলেন, ঠাকুর কদাচিৎ কখনও কলকাতা আসতেন; তা নয়ত সারা বছরই কাশীর বাঈজীকে মানে একটা মেয়েছেলে নিয়ে থাকতেন।
শুনে মুকুন্দ অবাক হয় না। ও মনে মনে বলে, তখন তো অনেক বাড়ির অনেক কর্তারই এই গুণ ছিল!
শুধু কী তাই? ঠাকুর নেশা-টেশা করে এলেই স্ত্রীকে নাকি খুব মারধর করতেন। বুড়ি কোনোমতে একবার নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, এই গোলাপী বাড়ির কোনো পুরুষ তো আমার কর্তার চাইতে বেশি আমোদ-আহ্লাদ করেনি কিন্তু যত নেশা করে যত রাত্তিরেই বাড়ি ফিরুন উনি আমার সঙ্গে কি অসম্ভব ভাল ব্যবহার করতেন, তা তোরা ভাবতে পারবি না।
মুকুন্দ খুব ভাল করেই জানে, বুড়ি যখন পুরনো দিনের কথা বলেন, তখন চট করে থামেন না। থামতে পারেন না। থামবেন কি করে? সেই পুরনো দিনের কিছু ধূসর স্মৃতি ছাড়া ওঁর আছে কী?
কামিনীবালা একটু থেমে মুখ-চোখ নেড়ে বলেন, মাথার উপর ঠাকুর আছেন মিথ্যে বলব না। আমরা বউরা যখন কাশী যেতাম, তখন ঠাকুর আমাদের জন্য কি না করতেন! পুত্রবধূদের উনি সত্যি নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করতেন।
সব মানুষেরই কিছু গুণ তো থাকে। এতক্ষণ পর মুকুন্দ প্রথম কথা বলে।
–সে তো একশবার। বুড়ি মায়া নেড়ে সমতি জানিয়ে বলেন, দত্তবাড়ির মেজ কর্তার কত দুর্নাম ছিল। তবে উনি এই বাড়ির ছোটকর্তার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন–যাকে বলে হরিহর আত্মা……
কথাটা শুনে মুকুন্দ একটু না হেসে পারে না।
–হাসছিস কিরে! এবার বুড়ি একটু হেসে বলেন, কখনও কখনও দুজনে মিলে কি কাণ্ডটাই না করতেন। কিন্তু দুজনেই কী উদার ছিলেন। ওঁদের কৃপায় অনেক ঝি চাকররাও এই কলকাতা শহরে বাড়ি-ঘর বানিয়ে নিয়েছে।
না, কামিনীবালা মিথ্যে বলেননি। তবে সে ঔদার্যের পিছনেও একটা কারণ ছিল। স্বার্থ ছিল। বিকৃত চিত্তবিনোদনের উপকরণ ছিল।
.
সে যাই হোক, বনবিহারী দত্ত কত শখ করে ভবানীপুরের বনেদী পাড়ায় যে ছোটোখাটো প্রাসাদোপম বাড়ি বানিয়েছিলেন, সেই বাড়ি এখন ভাঙা হচ্ছে। নতুন মালিক এখানে নাকি আধুনিক ও আরো বড় বাড়ি তৈরি করবেন। সত্যি মানুষ ভাবে। এক, হয় এক। এমন দিন যে কখনও আসবে, তা কে ভেবেছিলেন।
কেউ না। পরিবারের লোকজন তো দুরের কথা, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব প্রতিবেশীদের সবাই বলাবলি করতেন, দামোদর দত্ত ও তার পুত্র বনবিহারী দত্ত তাদের পারিবারিক যে ব্যবসা বাণিজ্য ধন-সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন, তা দশ পুরুষেও শেষ করতে পারবে না। তবে কথায় যে বলে, মানুষই লক্ষ্মী, মানুষই ঝক্কি। এই একটা পরিবারে কত অঘটনই ঘটল!
.
অগ্রদ্বীপের দত্ত পরিবারের সৌভাগ্যের প্রথম বুনিয়াদ রচনা করেন-নীলমণি দত্ত। কোম্পানির আমলের শেষ অধ্যায়ে বন্ড সাহেবের উনি সরকারবাবু ছিলেন; অর্থাৎ বন্ড সাহেবের সংসারের খানসামা, বাটলার, রাঁধুনি, ধোপানাপিত, ঝি-চাকর, দারোয়ান কোচোয়ান, বেয়ারা, খিদমতগার থেকে মালি ভিত্তি পর্যন্ত সব কর্মচারীর সর্বময় অধিকর্তা ছিলেন। কোম্পানির আমলে অন্যান্য সাহেবদের মতো বন্ড সাহেবও ব্যবসা বাণিজ্য জাল জুয়াচুরি করে দশ হাতে আয় করতেন। অন্য সাহেবদের মতো ইনিও মেমসাহেবকে এ দেশে আনেননি, মেমসাহেবও এই মশা-মাছি ম্যালেরিয়া কালাজ্বরের দেশে আসতে বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখাননি। তাই তো কোম্পানির অন্য সাহেবদের পদাঙ্ক ও দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বন্ড সাহেবও দেহ ও মনের দাবি মেটাবার জন্য দুটি নেটিভ রক্ষিত রেখেছিলেন। এই তিনটি সংসারের চেয়ার-টেবিল খাট-বিছানা থেকে শুরু করে শেরি-স্যাম্পেন-হুঁইস্কি মাছ-মাংস তরিতরকারি কেনার সব দায়িত্বই এই নীলমণির উপর ছিল। এবং প্রতিটি জিনিস কেনার জন্যই সরকারবাবু দোকানদারদের কাছ থেকে ভালরকম দস্তুরি পেতেন। এমন কি কোন ফেরিওয়ালা সাহেবের কুঠিতে ঢুকলেও ওর কিঞ্চিৎ প্রাপ্তিযোগ ঘটত। মাইনে আর কমিশন ছাড়াও চুরি-চামারি করে নীলমণি ভাল আয় করতেন।
কিন্তু বেচারা নীলমণি চিনির বলদের মতো সারাজীবন এই দস্তুরি আর চুরি চামারির নেশায় এমনই মশগুল ছিলেন যে উপভোগ করার সুয়োগ ও মন দুটোই হারিয়ে ফেলেন। নীলমণি দত্তর চোদ্দটি সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন দামোদর এবং ইনি একদিন ভাগ্যের সন্ধানে হাজারখানেক ভরি সোনা নিয়ে কলকাতা চলে আসেন।
.
দামোদর যেমন কর্মবীর তেমনই বুদ্ধিমান ছিলেন। উনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন, বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী। তাই তো উনি কিছুকাল কলকাতার বাজারে ঘোরাঘুরি পর একদিন সমস্ত সোনা বিক্রি করে থলিভর্তি টাকা নিয়ে সাসেক্স এঞ্জনিয়ারিংকোম্পানির বড় সাহেবের কাছে হাজির হয়ে সবিনয়ে নিবেদন করলেন, স্যার, আমি আপনার কোম্পানির মালপত্র বিক্রি করতে চাই।
সাহেব ওঁকে প্রশ্ন করলেন, টুমি বিজনেস করতা হ্যায়?
-নো সাহেব, নো। দিস মানি স্টার্ট বিজনেস।