- বইয়ের নামঃ চীনাবাজার
- লেখকের নামঃ নিমাই ভট্টাচার্য
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১-২. স্বভাব যায় না মলে
কথায় বলে, স্বভাব যায় না মলে, ইল্লত যায় না ধুলে। বৃদ্ধ অঘোর বাঁড়ুজ্যেরও হয়েছে তাই।
সেই কবে কোন কালে ছোটদাদু শিখিয়েছিলেন, আর্লি টু বেড অ্যান্ড আর্লি টু রাইজ, মেকস্ এ মান হেলদি…! তখন ওঁর কত বয়েস? বড় জোর পাঁচ-সাত। আর এখন এই বিরাশি বছরেও সে অভ্যেস ছাড়তে পারলেন না। জল-ঝড় শীত-গ্রীষ্ম যাই হোক, ভোর সাড়ে চারটেয় ওঠা চাই-ই চাই। মুখ-হাত ধুয়ে, বাথরুম পর্ব শেষ করে এক গেলাস ঠাণ্ডা জল খেয়ে পাঁচটার মধ্যে প্রাতঃভ্রমণে বেরুতেই হবে।
সেই পুরনো অভ্যেস এখনও আছে; তবে এখন আর বাইরে যান না। অঘোরনাথ ছাদেই পায়চারি করেন। কার সঙ্গে বেড়াতে যাবেন? বন্ধুবান্ধব তো দূরের কথা, এ পাড়াতে এখন একজন পরিচিত মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অথচ এই ভবানীপুরেই একদিন ওঁর জন্ম হয়; এখানেই শৈশব-কৈশোর-যৌবন কাটিয়েছেন। তখন কত অসংখ্য বন্ধুবান্ধব, পরিচিত ছিল চারদিকে।
ছোটদাদুর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার মধ্যে কি দারুণ রোমাঞ্চ ছিল; বাড়ি থেকে বেরিয়েই ছোটদাদু ওঁকে বলতেন, দাদুভাই, কুইক মার্চ।
ব্যস! শিশু অঘোরনাথ প্রায় দৌড়তে শুরু করতেন আর ছোটদাদু লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতেন। বড় রাস্তার মোড়েই দাঁড়িয়ে থাকতেন স্বয়ং রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার! স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়! অঘোরনাথ প্রায় ছুটে গিয়ে ওঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেন। স্যার আশুতোষ ওঁর মাথায় এক হাত রেখেই অন্য হাত দিয়ে পকেট থেকে ঘড়ি বের করে বলতেন, ত্রিদিব, আজও তুমি এক মিনিট দেরিতে এলে।
ছোটদাদু সঙ্গে সঙ্গে বলতেন, দাঁড়াও, ঘড়িটা মিলিয়ে দেখি। তারপর নিজের ঘড়িটা দেখেই বলতেন, তাই অ্যাম স্যরি আশুতোষ।
ছোটদাদু এইটুকু বলেই থামতেন না। বলতেন, আমি কথা দিচ্ছি আশুতোষ, কাল থেকে আর দেরি হবে না।
সেই সব দিনের কথা আজ যেন স্বপ্ন মনে হয়। ছোটদাদু ত্রিদিবনাথ বাঁড়ুজ্যে ছিলেন অঙ্কের অধ্যাপক আর স্যার আশুতোষ ছিলেন প্রখ্যাত বিচারপতি। কলকাতা ইউনিভারসিটির ভাইস-চ্যান্সেলার। রোজ সকালে অঙ্কশাস্ত্র নিয়ে দুই বন্ধুর তর্কাতর্কি দেখে অঘোরনাথ ঘাবড়ে যেতেন। ভয় পেতেন। মনে মনে ভাবতেন, হয়তো দুই বন্ধুর আর মুখ দেখাদেখিও হবে না। হা ভগবান! পরের দিন সকালবেলায় ঐ মোড়ের মাথায় পৌঁছেই দেখতেন, বাংলার বাঘ দাঁড়িয়ে আছেন। অত বড় গোঁফের তলা দিয়েও ওঁর মুখের হাসিটি দেখে শিশু অঘোরনাথও হেসে ফেলতেন।
দুই বন্ধুর একসঙ্গে প্রাতঃভ্রমণে বেরুতেও হবে, আবার তর্ক-বিতর্কও হবে। অঘোরনাথ কিছুই বুঝতে পারতেন না। কিছু যে জিজ্ঞেস করবেন, তাও সাহসে কুলোতে। তবে একটু বড় হবার পর উনি একদিন সত্যি সত্যি জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারলেন না–আচ্ছা ছোটদাদু, রোজ সকালে আপনারা দুই বন্ধু ঝগড়া করেন কেন?
ত্রিদিবনাথ এক গাল হাসি হেসে আদরের নাতিকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বলেন, না দাদুভাই, আমরা ঝগড়া করি না; তর্ক করি।
অঘোরনাথ অবাক হয়ে ছোটদাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
ছোটদাদু একটু থেমে আবার বলেন, আমি শুধু অঙ্ক শাস্ত্র নিয়ে একটু-আধটু পড়াশুনা করেছি আর আশুতোষ যে কোন শাস্ত্রে মহাপণ্ডিত না, তা ভগবানই জানেন। একটু তর্ক বিতর্ক না করলে কি ওঁর কাছ থেকে কিছু জানার উপায় আছে?
এই ছাদে পায়চারি করতে করতে বৃদ্ধ অঘোর বাঁড়ুজ্যের চোখের সামনে যেন সেইসব দিনের অবিস্মরণীয় স্মৃতি ভেসে ওঠে। একদিনের কথা ওঁর স্পষ্ট মনে আছে। কলেজ থেকে ফেরার পরই ছোটদাদু বললেন, দাদুভাই, আজ সন্ধেবেলায় আশুতোষের বাড়ি যেতে হবে।
সন্ধেবেলায়? কিশোর অঘোরনাথ একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করেন।
হ্যাঁ দাদুভাই, আজ ওকে অভিনন্দন জানাতে যাব। উনি একটু থেমে বলেন, আশুতোষের জন্যই এবার থেকে তোমরা ইউনিভারসিটিতে এম. এ. এম. এস-সি পড়তে পারবে। ও যে বাঙালির কি উপকার করল, তা এখন তুমি বুঝবে না। বড় হলে বুঝবে।
বিরাট দুহাঁড়ি রসগোল্লা আর বেশ কিছু বই নিয়ে সেদিন সন্ধেয় ত্রিদিবনাথ বন্ধু স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিলেন। সেদিন ওখানে কত বিখ্যাত পণ্ডিতের ভিড় দেখেছিলেন অঘোরনাথ, সে স্মৃতি কি ভুলে যাওয়া সম্ভব?
এই ভোরবেলায় পায়চারি করতে করতেই আরো কত কথা মনে পড়ে! এই ভবানীপুরে তখন কত বিখ্যাত জজ-ব্যারিস্টার, অধ্যাপক, উকিল আর ডাক্তার থাকতেন। ছোটদাদুর সঙ্গে টাউন হল বা অ্যালবার্ট হলের সভায় গেলে ভবানীপুরের কত মানুষকে দেখা যেত! আর এখন? প্রত্যেকটা বাড়ি বদলে গেছে। বদলে গেছে বাড়ির চেহারা, বদলে গেছে বাড়ির বাসিন্দারা! পাড়াটা দেখে যেন আর চেনা যায় না। অতীতের চিত্তচাঞ্চল্যময়ী উনযৌবনা নায়িকা যেন জরাগ্রস্তা, বিধবা! নাকি মানস-মন্দিরের সেই প্রতিমা কুলত্যাগিনী কলঙ্কিনী! দীর্ঘনিঃশ্বাসের ভারে অঘোরনাথ আর পায়চারিও করতে পারেন না, থমকে দাঁড়ান।
.
নামের ডাকে গগন ফাটে, ঢেঁকিশালে কুঁড়ো চাটে। সরকারদের বাড়িটাও হয়েছেই তাই। ঐ হতচ্ছাড়া আজ আবার সাত সকালে মুকুন্দর সঙ্গে ঝগড়া করছে। নিশ্চয়ই বউ বলেছে, চা-চিনি নেই। তাই মুকুন্দর দোকান থেকে চা নিতে গেছে। এই সাত সকালে কোন দোকানদার ধার দেবে? তার উপর বিনুর মতো খদ্দেরকে। সঙ্গে সঙ্গে বাবুর কি রাগ! দেখ মুকুন্দ, ভুলে যাস নে আমি সরকারবাড়ির ছেলে! তাছাড়া তুই আমাদের জমিতে আমাদের কৃপায় দোকান করেছিস।