নন্দা মাথা নেড়ে বলে—তা নয় গো। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন উঠছে না। সে আমার শত্রুতা করেছে আজীবন, আজও করছে। তা করুক। আমি ওকে ক্ষমা করতে চাই।
ওকে বাহুবন্ধনে জড়িয়ে বলি-দ্য ফাইন অ্যান্ড নোল ওয়ে টু ডেসট্রয় এ ফো ইজ টু কিল হিম; উইথ কাইন্ডনেস য়ু মে সো চেঞ্জ হিম দ্যাট হি শ্যাল সীজ টু বি সো; দেন হি ইজ স্লেইন! –বল তো কার কথা?
নন্দা নির্জীবের মতো বলে–জানি না।
আমি বলি—অ্যালেইনের। কিন্তু মিস রয় তো আমার ফো নয়, আমার স্টাফ। আমাকে খোঁজ নিতেই হবে। অন্যায় যদি সে করে থাকে তাহলে শাস্তিও পেতে হবে তাকে। বিশেষ, জেনে হোক না জেনে হোক, সে তোমাকে অপমান করেছে।
নন্দা কোনো কথা বলে না।
পরদিন মিস্ রয় সকল সংশয়ের ওপর যবনিকাপাত করল। ছাপানো গেজেট এনে প্রমাণ করল যে, সে প্রাইভেটে বি. এ. পাস করেছে। দ্বিতীয় শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান ছিল তার। রাজবন্দি হিসাবে সে পরীক্ষা দিয়েছিল।
সংবাদটা সুনন্দাকে দিলুম। এবারও সে কোনো কথা বলল না।
০২. কাজটা বোধ হয় ভালো করিনি
কাজটা বোধ হয় ভালো করিনি। অবশ্য এখন আর ভেবে কী হবে? কেন এ কাজ করলাম। কিন্তু করব নাই বা কেন? এইতো স্বাভাবিক। ভাগ্য বিড়ম্বনায় আজ ও বেচারি নেমে গিয়েছে অনেক নিচে। দু-মুঠো অন্নের জন্য বেচারিকে কত দরখাস্ত করতে হয়েছে। আর আমি আজ উঠে এসেছি ওর চেয়ে অনেক অনেক উঁচুতে। অথচ একদিন আমরা একই ক্লাসে বসতাম। একই বেঞ্চিতে। আমি ওকে দয়া না করলে কে করবে?
যেদিন অলক দরখাস্তের বান্ডিলটা আমাকে এনে দিল সেদিন কি স্বপ্নেও ভেবেছিলাম, ওর মধ্যে আছে একটি দীন আবেদন-মিস্ পর্ণা রায় করুণ ভাবে ভিক্ষা করছে একটি চাকরি— মিসেস সুনন্দা মুখার্জির স্বামীর কাছে? জানলে ও নিশ্চয়ই এখানে দরখাস্ত করত না। করত না? নিশ্চয়ই করত! যে রকম নির্লজ্জ আর হ্যাংলা প্রকৃতির মেয়ে ও—ঠিক এসে ধরনা দিত আমার কাছে। সোজাসুজি এসে ধরত আমাকে। কী বলতাম? বলতাম–আমি দুঃখিত। চাকুরিপ্রার্থিনীদের যোগ্যতা বিচারের ভার যার উপর তিনিই দেখে নেবেন। এ বিষয়ে কোনো অনুরোধ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ম্লান হয়ে যেত ওর মুখটা। কিন্তু না, ও যদি জানতে পারত যে, যে ছিল কলেজ-জীবনে তার চরমতম শত্রু-সেই সুনন্দা চ্যাটার্জির স্বামীই হচ্ছেন এই অলক মুখার্জি-তাহলে হয়তো ও এই চাকরির জন্য দরখাস্তই করত না। আমার তো বিশ্বাস আজও যদি সে ওকথা জানতে পারে তাহলে চাকরিতে ইস্তফা দেবে। তাই জানতে ওকে আমি দেব না। অর্থাৎ ভালো করে একদিন ওকে জানিয়ে দেব সেকথা।
সেদিন দরখাস্ত দেখেই ওকে চিনতে পেরেছিলাম। নিঃসন্দেহ হলাম ছবি দেখে। কিন্তু পর্ণা রায় এখনও মিস্ কেন? তাহলে গৌতম ব্যানার্জি কোথায় গেল? তা ছাড়া পর্ণা পাস করল কেমন করে? বছর পনেরো আগেকার কথা মনে পড়ছে। কী মধুর ছিল দিনগুলো! বোমার হিড়িকে আমরা সপরিবারে কলকাতা ত্যাগ করে আশ্রয় নিয়েছি মফস্বলের একটা শহরে। সে বছরই আমি আই. এ. পাস করলাম। বাবা কিছুতেই আর আমাকে কলকাতায় রাখবেন না। তার বিশ্বাস জাপানিরা নাকি আমারই মাথায় ফেলবে বলে বোমা জমিয়ে রেখেছে। তা ছাড়া কলকাতার বাড়িও তখন তালাবন্ধ। বাধ্য হয়ে নাম লেখালাম মফস্বলের সেই কলেজে।
শহরের একান্তে একটি রোমান ক্যাথলিক চার্চ। তার উল্টো দিকে ক্রিশ্চান মিশনারী স্কুল। মাঝখান দিয়ে কালো পীচমোড়া রাস্তাটা চলে গেছে কলেজের দিকে। না, ভুল বললাম! আমরা যখন পড়তাম তখনও রাস্তাটা ছিল লাল-খোয়াবাঁধানো ধুলোর রাস্তা। প্রথম যেদিন ক্লাস করতে গেলাম, সেদিনটার কথা স্পষ্ট মনে আছে। ক্লাস নিচ্ছিলেন বি. আর. ডি. জি.। পুরো নামটা আজ আর মনে নেই। কলেজের সব অধ্যাপককেই আমরা নামের আদ্যক্ষর দিয়ে উল্লেখ করতাম। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে ঘরে ঢুকবার অনুমতি চাইলাম। দেখলাম, সারা ক্লাসটা স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আজ না হয় আমার বয়স হয়েছে তখন আমি ছিলাম—যাকে বলে ডাকসাইটে সুন্দরী। ক্লাস ছুটি হতে মেয়েরা সব যেচে ভাব করতে এল আমার সঙ্গে। কদিনেই লক্ষ্য করলাম ছেলেগুলো আমাকে কেন্দ্র করেই ঘুরঘুর করছে। হাত থেকে রুমালটা পড়ে গেলে পাঁচটা ছেলের মাথা ঠোকাঠুকি হয়ে যায়–কে আগে কুড়িয়ে দিতে পারে। অল্পদিনেই শুনতে পেলাম, আমার নতুন নামকরণ হয়েছে–কলেজ-কুইন!
কলকাতা কলেজের অভিজ্ঞতা ছিলই, বরং মফস্বলের ছেলেরা একটু মুখচোরা। তা হোক, তবু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই প্রচারিত হয়ে গেল আমার কথা—শুধু সুন্দরী বলে নয়, ভালো ছাত্রী বটে, বেস্ট ডিবেটার বলে, টেবিল-টেনিস চ্যাম্পিয়ান বলে। আমার অপ্রতিহত গতির সামনে কেউ কোনো দিন এসে দাঁড়াতে সাহস পায়নি। আমি কলেজে আসতাম একটি লেডিজ-সাইকেলে চেপে। প্রথম দিন ক্লাস ছুটি হবার পর দেখি চাকায় হাওয়া নেই। বুঝলাম কেউ দুষ্টুমি করেছে। কয়েকটি ছেলে গায়ে পড়ে সহানুভূতি জানাতে এল। পাম্প করে দেবার প্রস্তাব করল কেউ কেউ। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে অস্বীকার করলাম। কলেজ থেকে অদূরে ক্রিশ্চানপাড়ার মোড়ে ছিল একটা সাইকেল-সারানোর দোকান। সেখানে পাম্প করিয়ে নিলাম। দোকানির সঙ্গে বন্দোবস্ত করলাম সেটা মাসিক এক টাকায় জমা রাখার। দু-একবার ক্লাসের বোর্ডে কলেজ-কুইনের নামে অহেতুক উচ্ছ্বাস-মাখানো দু-এক লাইন কবিতা পড়েছি। গ্রাহ্য করিনি। বুঝতাম, এগুলো আমার প্রাপ্য। কই, আর কারও নামে তো কবিতা লেখা হয় না!