পরদিনই মিস রয়কে বলি–আপনার ক্রিডেনশিয়ালগুলোর অ্যাটেসটেড কপিই দেখা আছে আমার। কালকে অরিজিনাল সার্টিফিকেটগুলো সব একবার আনবেন তো।
ঈগলদৃষ্টি-দগ্ধী দৃষ্টি পড়ে আমার মুখের ওপর।
—হঠাৎ, এতদিন পরে?
—হ্যাঁ। তাই নিয়ম। অরিজিনাল সার্টিফিকেটগুলো দেখে আপনার সার্ভিস-বইতে সই করে দিতে হবে আমাকে। কাল সব নিয়ে আসবেন। ডিগ্রি সার্টিফিকেটখানাও।
–ডিগ্রি সার্টিফিকেটখানা তো কাল আনতে পারব না স্যার। সেটা দেশে আছে। অন্যান্য মূল কাগজ অবশ্য আনব।
কেমন যেন সন্দেহ বেড়ে যায়! সবই আছে কাছে, আর ডিগ্রি সার্টিফিকেটখানাই দেশের বাড়িতে আছে? কিন্তু যখন ধরেছি তখন শেষ পর্যন্ত দেখতে হবে আমাকে। বাধ্য হয়ে বলি—বেশ, উইকেন্ডে আনিয়ে নেবেন। না হয় দুদিন ছুটিই নিন।
—দেশ মানে স্যার, পাকিস্তান। সে তো আনা যাবে না সার। একথার পর সন্দেহ আর বাড়ে না! এতক্ষণে নিঃসন্দেহ হওয়া গেল। মেয়েটি বি. এ. পাস করেনি আদপে। কিন্তু কী দুঃসাহস! সুনন্দার বান্ধবী বলে ক্ষমা করতে পারব না আমি। এ অপরাধ অমার্জনীয়। পুলিশে অবশ্য ধরিয়ে দেব না, কিন্তু চাকরিতেও রাখতে পারব না ওকে। আমার স্টেনো হিসাবে অনেক গোপন খবর ও অনিবার্যভাবে পাবে। যে মেয়ে এত বড় জালিয়াতি করতে পারে, তার পক্ষে সবই সম্ভব। কে জানে, অফিসের গোপন খবর জেনে নিয়ে হয়তো শেষে আমাকেই ব্ল্যাকমেইলিং শুরু করবে। অগত্যা সুকৌশলে এগিয়ে যেতে হল আমাকে।
–আই সী! দেশ মানে পূর্ব-পাকিস্তান! তা কোন ইয়ারে বি. এ. পাস করেন আপনি?
-বেয়াল্লিশ সালে।
–কোন কলেজ থেকে?
–প্রাইভেটে।
–কোনো কলেজে পড়তেন না আপনি?
–পড়তাম। পরে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিই।
–অনার্স ছিল বলেছিলেন—না?
-হ্যাঁ, স্যার, বাংলায়—সেকেন্ড ক্লাস সেকেন্ড হয়েছিলাম। ফার্স্ট ক্লাস সেবার কেউ পায়নি।
–ও। তা কোন কলেজে পড়তেন আপনি?
পর্ণা যে মফস্বল কলেজটির নাম করে সেখান থেকেই সুনন্দা বি. এ. পরীক্ষা দিয়েছিল। এবার তাই প্রশ্ন করি–আচ্ছা, আপনাদের ঐ কলেজে সুনন্দা চ্যাটার্জি বলে একটি মেয়ে পড়ত?
ডিটেশনের পেনসিলটা দিয়ে কপালে মৃদু মৃদু টোকা দিয়ে পর্ণা একটু ভেবে নিয়ে বললে–সুনন্দা! না! মনে পড়ছে না তো? কেমন দেখতে বলুন তো?
–খুব সুন্দরী একটি মেয়ে?
—কই, মনে তো পড়ছে না! সুমিত্রা না সুপ্রিয়া নামে একটা মেয়ে আমাদের ক্লাসে ছিল মনে হচ্ছে-বড়লোকের মেয়ে, একটু পুরুষালিভাব, খেলাধুলা সাইকেল চড়ায় মাতামাতি করত—কিন্তু সুন্দরী তাকে কেউ বলবে না। রঙটা অবশ্য কটা ছিল মেয়েটির, কিন্তু মুখ ছিল গোলগাল, হুলো বেড়ালের মত।
আপাদমস্তক জ্বলে ওঠে আমার! মেয়েটি শুধু জালিয়াতিই নয়, চালিয়াতও। কলেজ জীবনে যে ছাত্রীটির কাছে সব বিষয়ে হার স্বীকার করতে হয়েছে, আজ তার অস্তিত্বটাই স্বীকার করতে চায় না! মনে মনে বললুম-তুমি জানতেও পারলে না পর্ণা, তোমার যে সহপাঠিনীকে আজ তুমি চিনতে চাইছ
-যার সৌন্দর্যে আজও ঈর্ষান্বিত হয়ে তুমি ব্যঙ্গবিদ্রুপ করছ, সেই মেয়েটির উদারতাতেই আজ তোমার রান্নাঘরে দুবেলা উনুন জ্বলে!
–তা আপনি এই সুনন্দা চ্যাটার্জিকে চেনেন নাকি স্যার?
আমি এ প্রসঙ্গ চাপা দিয়ে বলি—এই চিঠিগুলো টাইপ করে আনুন!
মেয়েটি বুদ্ধিমতী। তৎক্ষণাৎ চিঠির কাগজগুলো নিয়ে সরে পড়ে।
বুঝলুম, মেয়েটি নির্জলা মিথ্যা কথা বলেছে। মফস্বলের গভর্নমেন্ট কলেজ। কোয়েডুকেশন ছিল! সুতরাং ছাত্রী ছিল মুষ্টিমেয়। নন্দার কাছে গল্প শুনেছি-তার নাম ছিল কলেজ-কুইন। ফার্স্ট ইয়ার থেকে ফোর্থ-ইয়ার পর্যন্ত প্রত্যেকটি ছেলে, মায় দপ্তরী-বেয়ারাগুলো পর্যন্ত চিনত তাদের কলেজ-কুইনকে। আর মিস্ রয় তার সহপাঠিনী হয়ে তাকে চিনবে না, এ হতে পারে না। পর্ণা নিশ্চয় জানে না যে, ঐ সুনন্দাই তার বসের ঘরণি; জানলে এ সুরে কথা বলত না সে। কিন্তু তা হলেও পর্ণার হিংসুটে মনের কী কদর্য রূপটাই দেখতে পেলুম মুহূর্তে। ওর প্রতি যেটুকু করুশা সঞ্চারিত হয়েছিল তা ভেসে গেল ওরই কথায়। প্রভু-ভৃত্য ছাড়া ওর সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখা চলবে না। কিন্তু না! সে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। যে মেয়ে য়ুনিভার্সিটির ডিগ্রি জাল করতে পারে তাকে অফিসে রাখা চলে না।
রাত্রে সব কথা নন্দাকে খুলে বলি। নন্দা যেন জ্বলে ওঠে–কী বলল সে? হুলো বেড়ালের মত?
আমি বলি–আহাহা, সে তো আর তোমাকে বলেনি।
–আমাকে না তো আর কাকে?
–যাক, আমার কী মনে হয় জান? মেয়েটি সত্যিই পাস করতে পারেনি। তাই বললে, ডিগ্রি সার্টিফিকেটখানা পাকিস্তানে আছে।
—তাতে আর সন্দেহ কী?
—আমি খোঁজ নিয়ে বার করব!
—কোথায় খোঁজ নেবে?
–তাই তো ভাবছি।
–খোঁজ অবশ্য তুমি য়ুনিভার্সিটি লাইব্রেরীতেই পেতে পার। কিন্তু আমি কী বলি জান? থাক না। খুঁচিয়ে ঘা করে কী লাভ? দুটো পয়সা করে খাচ্ছে। তুমি বলছ, এতে জেল পর্যন্ত হতে পারে?
—হতে পারে মানে? হবেই।
–তবে থাক। আমরা বরং ধরে নিই পর্ণা সত্যি কথাই বলেছে!
আমি বলি—দেখ নন্দা, স্যার ফিলিপ সিড়নি বলেছেন,–দ্য ওনলি ডিসঅ্যাডভান্টেজ অফ অ্যান অনেস্ট হার্ট ইজ ক্রেডুলিটি। অর্থাৎ কিনা, মহৎ হৃদয়ের একমাত্র অসুবিধা হচ্ছে তার বিশ্বাসপ্রবণতা। তোমার অন্তঃকরণ মহৎ, তাই তুমি অন্ধ বিশ্বাস করতে চাইছ। কিন্তু বিজনেসে অন্ধ বিশ্বাসের স্থান নেই।