এ সব কথাই কিন্তু একেবারে প্রথম দিন মনে হয়নি। পরে হয়েছে। আমি যখন ডিটেশন দিই ও মাথা নিচু করে কাগজের ওপর দুর্বোধ্য আঁচড় টানতে থাকে। আমি ওর নতনেত্রের দিকে তাকিয়ে থাকি। সেখানেও যেন আমার অজানা ভাষায় কোন দুর্বোধ্য আঁচড় পড়ছে। আমি সে চোখের ভাষা পড়তে পারি না, ও পারে। আবার টাইপ-করা কাগজখানি সই করার আগে আমি যখন পড়তে থাকি ও সামনে বসে থাকে চুপ করে। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তখন বুঝতে পারে যে, সে আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। সে চাহনি ঈগল দৃষ্টিকে অন্ধ করে দেবার ক্ষমতা রাখে! আমি অসোয়াস্তি বোধ করি। পড়তে পড়তে যখনই চোখ তুলি–তৎক্ষণাৎ সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।
এ সব কথাই কিন্তু প্রথম দিন মনে হয়নি। ক্রমে হয়েছে।
আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে, সুনন্দার আগ্রহাতিশয্যে এই মেয়েটিকে চাকরি দিয়েছি। সে কথা মনে পড়ল একদিন সুনন্দার কথাতেই। হঠাৎ ও একদিন প্রশ্ন করে বসল–পর্ণা কেমন কাজ করছে?
—পর্ণা কে? আমি প্রতিপ্রশ্ন করি। আমার স্টেনোকে আমি মিস রয় বলেই ডাকি। তার নাম যে পর্ণা সে কথা সে সময়ে আমার খেয়াল ছিল না।
সুনন্দা ফোঁস করে ওঠে—অতটা ভালোমানুষী ভালো নয়; তোমার স্টেনোর নাম পর্ণা নয়?
-ও! মিস্ রয়? হ্যাঁ, তা ভালই কাজ করছে। কেন?
—না, তাই জিজ্ঞাসা করছি। আমার অনুরোধে ওকে চাকরি দিলে তো। তাই জানতে চাইছি, আমার নির্বাচন তোমার পছন্দ হয়েছে কিনা।
এই পছন্দ-অপছন্দ কথাগুলি বড় মারাত্মক। তাই ও প্রসঙ্গ চাপা দিয়ে বলি—একদিন বাড়িতে নিয়ে আসব? আলাপ করবে?
সুনন্দা অস্বাভাবিকভাবে চমকে ওঠে। আর্ত কণ্ঠে বলে–না না না! অমন কাজ তুমি কর না।
আমি অবাক হয়ে যাই। বলি–ব্যাপার কী? এতটা ভয় পাওয়ার কী আছে? সে তো আর কামড়ে দেবে না তোমাকে?
সুনন্দা ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকের ছলে বলে–কী করে জানলে?
—জানলুম, কারণ এতদিনেও আমাকে একবারও কামড়ায়নি।
–তাই নাকি। যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল!
আমি বলি—নন্দা, তুমি আমাকে সেদিন মিছে কথা বলেছিলে, মেয়েটিকে তুমি চিনতে। সুনন্দা এতদিনে স্বীকার করে।
—তাহলে সেদিন বলনি কেন?
এতদিনে সব কথা খুলে বলল সে। বললে—পর্ণা আমাদের কলেজে পড়ত। একই ইয়ারে। খুব গরিব ঘরের মেয়ে। তাই ভেবেছিলাম–যদি বান্ধবীর একটা উপকার করতে পারি। তোমাকে বলিনি, পাছে আমার বান্ধবী বলেই তোমার আপত্তি হয়।
—তাহলে ওকে এখানে আনতে তোমার এত আপত্তি কিসের?
—ও লজ্জা পাবে বলে। তোমার কাছে স্বীকার করতে সংকোচ নেই–ও ছিল আমার প্রতিদ্বন্দ্বিনী। ক্লাসে কোনোবার ও ফার্স্ট হয়েছে কোনোবার আমি। দুজনেরই বাংলায় অনার্স ছিল। অন্যান্য ক্ষেত্রেও মেয়েটি আমার সঙ্গে টেক্কা দিতে চাইত। অবশ্য প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সে হেরে গিয়েছে আমার কাছে। খেলাধুলা, ডিবেট ইত্যাদিতে আমার কাছে হার স্বীকার করেছিল। তাই আমাকে ভীষণ হিংসে করত। আজ যদি সে জানতে পারে–আমারই অনুগ্রহে ওর চাকরি হয়েছে—তখন ব্যথাই পাবে সে মনে মনে। ওদের বাড়ির যে অবস্থা তাতে চাকরি ও ছাড়তে পারবে না–অথচ প্রতিদিনের কাজ আত্মগ্লানিতে ভরে উঠবে ওর।
সুনন্দার উদারতায় মুগ্ধ হয়ে গেলুম। সে গোপনে উপকার করতে চায়। যার অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিল—পাছে সে লজ্জা পায়, ব্যথা পায়, তাই সে কথা জানাতেও চায় না। ওর সব কথা শুনে স্নেহে শ্রদ্ধায় মনটা ভরে ওঠে! ওর মনের যেন একটা নতুন দিগন্ত উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। শুধু বহিরঙ্গই সুন্দর নয়, ওর অন্তরটাও সোনা দিয়ে মোড়া। ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলিখেলাধুলা, ডিবেট, পড়াশুনা সব ক্ষেত্রেই তো তাকে হারিয়ে দিয়েছিলে—কিন্তু কলেজ জীবনের আসল প্রতিযোগিতার কথাটা তো বললে না?
—আসল প্রতিযোগিতা মানে?
–মদন-মন্দিরের প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতে হয়নি তোমাদের?
ও হেসে বলে—এ তো তোমাদের বিলেতের কলেজ নয়।
আমি বলি—তাহলে ফাইনাল-রাউন্ডের খেলাটা হয়নি। কিন্তু সেমি-ফাইনালের খেলাতে ও তোমাকে হারিয়ে দিয়েছে নন্দা।
আমার বুক থেকে মুখ তুলে ও বলে–তার মানে?
—মিস্ রয় অনার্স নিয়েই বি. এ. পাস করেছে। সুনন্দা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে বলে-তুমি ওর অরিজিনাল সার্টিফিকেট দেখেছ?
–না, কেন?
–পর্ণা বি. এ. পরীক্ষা দেয়নি।
–কী বলছ যা তা, তাহলে দরখাস্তে ও কথা লিখতে সাহস পায়?
–আমি নিশ্চিতভাবে জানি। আমরা একই ইয়ারে পড়তাম। বেয়াল্লিশ সালে আমাদের পরীক্ষা দেবার কথা ছিল। পরীক্ষার আগেই ওকে পুলিশে ধরে। তারপর আটচল্লিশ সাল পর্যন্ত ও ছাড়া পায়নি। ইতিমধ্যে ওর বাবা মারা যান। আর পরীক্ষা দেওয়া হয়নি ওর।
আমি বলি—এও কি সম্ভব? পাস না করেই মেয়েটি নামের পাশে বি. এ. লিখেছে?
সুনন্দা বলে—পর্ণার পক্ষে সবই সম্ভব।
—বেশ, খোঁজ নেব আমি।
—না থাক, দরকার কী? অত্যন্ত গরিব ঘরের মেয়ে পর্ণা। বাপও মারা গেছে। ওর সঙ্গে কলেজে, একটি ছেলের খুবই মাখামাখি হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম, তার সঙ্গেই ওর বুঝি বিয়ে হয়েছে। দরখাস্ত পড়ে বুঝলাম তা হয়নি। কী দরকার এ নিয়ে খুঁচিয়ে ঘা করার। অহেতুক চাকরিটা খোয়াবে বেচারি। খাবে কী?
আমি বলি—কী যা তা বকছ নন্দা! এ তো জালিয়াতি রীতিমতো! জেল পর্যন্ত হতে পারে এ জন্য।
-বল কী, জেল পর্যন্ত হতে পারে? কিন্তু প্রমাণ করবে কী করে?
এ আলোচনা এখানেই বন্ধ করে দিই, বলি—এক কাপ কফি খাওয়াতে পার?