—কিন্তু না দেখলে তুলনামূলক বিচার তো তুমি করতে পারবে না!
–না হয় নাই পারলুম।
–তাহলে বরং আমার সঙ্গে তুলনা করে বল। না কি, আমার দিকেও কখন চোখ তুলে দেখনি তুমি?
বললুম–মাপ কর নন্দা, সে আমি পারব না। তোমার সঙ্গে কোনো মেয়ের তুলনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমার পাশাপাশি কোনো মেয়েকে বসিয়ে মনে মনে তুলনা করছি—এটা আমি ভাবতেই পারি না। করলেও বিচারটা ঠিক হবে না। সে ক্ষেত্রে হয়তো মিস্ য়ুনিভার্সও আমার কাছে পাস-মার্ক পাবেন না।
সুনন্দা লজ্জা পায়। বলে–যাও, যাও। অতটা ভালো নয়।
সুনন্দা জানে, আমি মিথ্যা কথা বলিনি। সে মর্মে মর্মে জানে যে, তার রূপের জ্যোতিতে আমি অন্ধ হয়েই আছি। গাল দুটি লাল হয়ে ওঠে, দৃষ্টি হয় নত। রূপের প্রশংসা করলেই নন্দার ভাবান্তর হয়। অথচ তার রূপের প্রশংসা আমাকে প্রায় প্রত্যহই করতে হয়।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, এ জন্যে আমাকে মিথ্যাভাষণ করতে হয় না। বস্তুত সুনন্দা নিজেও জানে যে, সে অপূর্ব সুন্দরী। আমি না বললেও পথচারীরা বিস্ফারিত মুগ্ধ দৃষ্টির লেফাফায় এ বারতা তাকে নিত্য জানায়। আমি অবশ্য তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করি অন্য কারণে। আমি তার রূপের প্রসঙ্গ তুললেই সে লজ্জা পায়–লাল হয়ে ওঠে। যে কারণে বাড়িতে নিত্য ফুলের ব্যবস্থা করেছি ঠিক সেই কারণেই আমি মাঝে মাঝে ওর রূপের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করি। তখনই মনে পড়ে কবি গ্রেগরীর সেই কথা—-হোয়েন এ গার্ল সিজেস টু ব্লাশ, শী হ্যাজ লস্ট দ্য মোস্ট পাওয়ারফুল চার্ম অব হার বিউটি। অর্থাৎ, কোনও একটি মেয়ে তার সৌন্দর্যের প্রধান চার্মটি, মানে আকর্ষণটি তখনই হারিয়ে ফেলে যখন থেকে সে-কী আশ্চর্য! ব্লাশের বাংলা কী? লজ্জায় লাল হয়ে ওঠা? নাঃ! বাংলায় ডায়েরি লেখা এরপর বন্ধ করে দেব। একটা ভালো কথা যদি বাংলায় লেখা যায়!
মোট কথা, সুনন্দা আমাকে জোর করে ধরে বসল, ঐ মেয়েটিকেই চাকরিটা দিতে হবে। কেন, তা বলল না। মেয়েটির দরখাস্তখানি বার করলুম। পর্ণা রায়, বি. এ.। ইতিপূর্বে কোথাও চাকরি করেনি। সম্প্রতি কমার্সিয়াল কলেজ থেকে স্টেনোগ্রাফি পাস করেছে, স্পীডের উল্লেখ করেনি। অপরপক্ষে অন্যান্য প্রার্থিনীদের সুপারিশ ছিল, প্রাক্তন অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর ছিল অভিজ্ঞানপত্রে (টেস্টিমোনিয়ালের বাংলা ঠিক হল তো?)। সে কথা নন্দাকে বললুম। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। এ রকম বিপাকে পড়লে আপনারা যা করতেন আমিও তাই করলুম-কথা দিই–মোটামুটি যদি ডিকটেশন নিতে পারে, তবে তাকেই রাখব। আমি আমার কথা রেখেছি। না, ভুল হল, আমি যা কথা দিয়েছিলুম তার বেশিই করেছি। মেয়েটি মোটামুটি ডিটেশনও নিতে পারেনি। তবু তাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারিনি। কেন? কারণ, আমি বুঝতে পেরেছি ভিতরে কোনও ব্যাপার আছে। সুনন্দা কি মেয়েটিকে চেনে? তাহলে স্বীকার করল না কেন? আমি যতই তাকে পীড়াপীড়ি করি, সে অন্য কথা বলে এড়িয়ে যায়। একবার বলল—অন্যান্য দরখাস্তকারিণীদের তুলনায় এ মেয়েটির রূপের সম্ভার অল্প। কথাটা, জানি, ডাহা মিথ্যে! না না, অন্যান্য ফটোর সঙ্গে তুলনা করে এ কথা বলছি না। বস্তুত অন্যান্য ছবিগুলি আমি আজও দেখিনি। (পাঠক! তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না, না? না হতে পারে, তুমি তো আমার সুনন্দাকেও দেখনি!) সম্ভবত সুনন্দা নিজেও দেখেনি। কারণ আমি জানি, সে ভয় নন্দার কোনোদিন ছিল না, থাকতে পারে না। সে জানে, অলক মুখার্জি আর যাই করুক স্ত্রীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করবে না। আর একবার ও বললে—বেকার মেয়েটি যে ভাবে দূরখাস্তে করুণ ভাষায় আবেদন করেছে তাতেই সে বিচলিত হয়েছে। এটাও বাজে কথা। কারণ সকলের দরখাস্তের ভাষাই প্রায় একরকম। শেষে বলে-দেখ, অন্যান্য মেয়ের পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে, তারা সহজেই অন্যত্র চাকরি জুটিয়ে নেবে। এ করা শক্ত। এ কথাটাকে একেবারে উড়িয়ে দিতে পারা যায় না। কিন্তু আমার বিশ্বাস এটাও আসল কথা নয়। আসল কথা, মেয়েটি সুনন্দার পূর্ব-পরিচিত। তবে সেকথা ও স্বীকার করল না কেন?
কারণটাও অনুমান করতে পারি। সুনন্দা জানে আমি আদর্শবাদী। স্ত্রীর পরিচিত কাউকে চাকরি দেওয়ার অর্থ নেপটিজম, অর্থাৎ আত্মীয়-পোষণ। পর্ণা অবশ্য আমার আত্মীয় নয়, কিন্তু নেপটিজমের বাংলা কি ঠিক আত্মীয়-পোষণ? পরিচিত-পোষণ বলব কি? দূর হোক, বাংলা না হয় নাই করলুম। জিনিসটা তো খারাপ? সুনন্দা জানে, অলক মুখার্জি কখনও নেপটিজমের কবলে পড়বে না স্ত্রীর অনুরোধেও নয়। সম্ভবত সেই জন্যেই সে আসল কারণটা গোপন করে গেল।
এ প্রায় দেড় মাস আগেকার ঘটনা। ছয় সপ্তাহ আগে কোম্পানির খাতায় একটি নতুন নাম উঠেছে। পর্ণা রায়, বি, এ. লম্বা একহারা বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। শ্যামলা রঙ। সমস্ত অবয়বের মধ্যে আশ্চর্য আকর্ষণ ওর চোখ দুটিতে। যেন কোন অতলস্পর্শ গভীরতার স্বপ্নে বিভোর। দিনান্তের শেষ শ্যামলছায়া যেমন দিগন্তের চক্ৰবালে আপনাতেই আপনি লীন হয়ে থাকে–মেয়েটির অন্তরের সব কথাই যেন তেমনি দুটি চোখের তারায় মগ্ন হয়ে আছে। ওর সে চোখের দিকে চাইলে মনে হয় সেখানে কোনো নিগুঢ় স্বপ্ন নিঃসাড়ে সুপ্তিমগ্ন। তখন মনে হয় না যে, ঐ ছায়া-ঘন শান্ত দিচ্চক্ৰবালেই হঠাৎ ঘনিয়ে আসতে পারে কালবৈশাখীর কুটি। তখন সে চোখের দিকে তাকাতে ভয় হয়। আবার ঐ চোখেই ঘন কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে হঠাৎ উঁকি দেয় অস্তসূর্যের শেষ স্বর্ণাভা! তখনও সে চোখের দিকে তাকানো যায় না—চোখ ঝলসে যায়। নন্দার চোখ দুটিও সুন্দর। অনিন্দ্য। সমস্ত মুখাবয়বের সঙ্গে অত্যন্ত মানানসই। কিন্তু সে চোখ জুলে। সে যেন হরিণের চোখ—শান্ত, করুণ, উদাস—সরল সারঙ্গ দৃষ্টি। টেনিসনের ভাষায়–হার আইজ আর হোমস অব সাইলেন্ট প্রেয়ার–সে চোখে যেন উপাসনা-মন্দিরের স্নিগ্ধ সৌম্যতা। আর এই মেয়েটির চোখের দৃষ্টিতে মনে পড়ে শেক্সপীয়ারকে–এ লাভার্স আইজ উইল গেজ আন ঈগল ব্লাইন্ড! ঈগল পাখিও সে চোখের দিকে চাইলে অন্ধ হয়ে যায়।