—ইউ শাট আপ! মিথ্যা কথা! বানিয়ে বানিয়ে কী সব যা-তা বকছু তুমি?
পর্ণার ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে একটা অদ্ভুত টান। বলে—আর কোনো লাভ নেই অলক, মিসেস মুখার্জি সব কিছুই আন্দাজ করতে পারছেন। আর তা ছাড়া অতটা লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই তোমার। সুনন্দা দেবীও কিছু গঙ্গাজলে যোওয়া তুলসীপত্রটি নন। না হয় ওঁকেই জিজ্ঞাসা করে দেখ। শাঁখা-সিঁদুর পরে বাসে-ট্রামে বেলেঘাটা অঞ্চলে কোথায় যেতেন উনি! বিশ্বাসঘাতক তো আমি একা নই–তুমি, আমি, সুনন্দা দেবী–আমরা সবাই।
অলক আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। দরজার দিকে আঙুল বাড়িয়ে বলে-গেট আউট!
পর্ণা বলে-–থাক, দারোয়ান ডাকতে হবে না। যাচ্ছি। কিন্তু এখনও একটা কাজ যে বাকি আছে স্যার। আমাদের শ্রমিক য়ুনিয়ানের চাঁদার খাতায় একটা সই দিতে হবে আপনাকে।
টেবিলের ওপর চাঁদার খাতাখানা মেলে ধরে বলে—একশো টাকার নম্বরী নোট, বেহিসাবি এত টাকা আমার ব্যাগে থাকাটা ঠিক নয়।
–ড্যাম ইট! ঘসঘস করে সই করে দেয় অলক।
চার বান্ডিল নোট তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় পর্ণা। পরিত্যক্ত নোটের বান্ডিলটার দিকে ঘৃণাকুঞ্চিত আঙুল তুলে অলক বলে-ওটা?
–ওটা আমার দুশ টাকা হিসাবে পাঁচ মাসের মাইনে। ওটা তুলে রাখ!
কাঁপতে কাঁপতে অলক আবার গর্জে ওঠে–আই সে, টেক ইট!
যাবার জন্য পা বাড়িয়েছিল পর্ণা। এ কথায় ঘুরে দাঁড়ায়।
বলে—না! তোমার প্রতি যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি, তার মূল্য ঐ হাজার টাকাই! সে মূল্য আমি মিটিয়ে দিয়ে যাব।
তারপর আমার দিকে ফিরে বলে–আমরা সবাই তো বিশ্বাসঘাতক। কিন্তু জেনে রাখুন মিসেস্ মুখার্জি, পার্টির নির্দেশে আমি এখানে যা কিছু করেছি তা আমার স্বামী জানেন—তাঁর কাছে কিছুই লুকোইনি আমি। আচ্ছা চলি, নমস্কার।
আমার মাথার মধ্যে সব গোলমাল হয়ে গিয়েছে তখন!
ঠিকভাবে কিছুই আর চিন্তা করতে পারছি না।
ওর শেষ কথাগুলিই মনে পড়ছে কেবল!
ওর ঐ শেষ বিষ-উদগীরণটা কি একটা মিথ্যা কাহিনীর ওপর প্রতিষ্ঠিত? চিঠি-ফটো-হোটেল–সব-সবই কি অলীক কাহিনী?
আমার চরিত্রবান স্বামীর কাছে আমল না পেয়ে নিস্ফল আক্রোশে পরাজয়ের জ্বালা ভুলবার জন্যেই কি এই অন্তিম দংশন করে গেল কালনাগিনী? অথবা আমিই ছিলাম তার লক্ষ্যস্থল? আমাকেই বিষজর্জরিত করে গেল সে এই কুহকী মায়ার ছলনায়?
কিংবা হয়তো, হয়তো কিছুই মিথ্যা বলেনি সে।
বিষকন্যার বিষে বুঝি নীল হয়ে গেল এ সোনার সংসার!
কিন্তু তাই যদি হবে তাহলে সে কি সত্যিই পারবে গৌতমকে সব কথা খুলে বলতে? দারোগাবাবুর কাছে সারারাত স্বেচ্ছায় আটক ছিল যে মেয়েটি সে কি পারত, বিয়ে হলে, তার স্বামীকে সে রাত্রের সব কথা বলতে?
জানি, এ সব প্রশ্নের উত্তর কোনোদিনই খুঁজে পাওয়া যাবে না!
তা না যাক, তবু বলব আমার অঙ্কে শুধুই লোকসান জমা পড়েনি। এ আঘাতের প্রয়োজন ছিল–ওর, আমার, আমাদের দুজনেরই। বৈচিত্র্য চেয়েছিলাম না আমি? তা সে বৈচিত্র্যও এসেছিল আমাদের দাম্পত্য জীবনে, চরম সর্বনাশীর বেশে। তাতে আমরা দুজনেই বুঝতে শিখেছি, আমাদের দুর্বলতা কোথায়। বড় বেশি জাঁক হয়েছিল আমাদের। ঠিক কথা, এ আঘাতের প্রয়োজন ছিল।
উঠে এলাম অলকের কাছে। ওর হাতটা তুলে নিয়ে বলি-চল, বাড়ি চল।
ও কী যেন ভাবছিল। চমকে উঠে বলে–অ্যাঁ?
বলি–এতটা বিচলিত হচ্ছ কেন? আমি ওর একটা কথাও বিশ্বাস করিনি। ভেঙে পড়লে তো চলবে না। ওঠ, চল।
—কোথায়?
–কোথায় আবার কী? বাড়িতে। তোমার অলকনন্দায়।
অলক আমার মাথাটা টেনে নিয়ে বলে–তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ?
আমি হেসে বলি, অলক, বল দেখি–কে বলেছেন—দে হু ফরগি মোস্ট শ্যাল বি মোস্ট ফরগিভন্?
আমার হাত দুটি ধরে অলকও হেসে ফেলে।
বলে-বেইলি।