অলক ঘরময় পায়চারি করছিল। আমাদের কথোপকথন তার কানে যাচ্ছে বলে মনে হয় না। নিজের আসুনে এসে বসে এতক্ষণে। অর্ধদগ্ধ সিগারেটটাকে অ্যাশট্রের গায়ে ঘষে ঘষে থেতলে দেয়। তারপর গম্ভীর হয়ে বলে–বিশ্বাসঘাতকতা করবার জন্য আমরা আপনাকে মাসে মাসে মাইনে দিয়েছি? এই কি আপনার ধারণা?
–ঠিক তাই। ধারণা করা অন্যায় নয় নিশ্চয়ই। আমার আর কী কোয়ালিফিকেশন আছে বলুন? স্টেনো হিসাবে আমার যোগ্যতা যে কতখানি তা আর কেউ না জানুক আপনি-আমি তো জানি! লোকে স্টেনো রাখে চারটি কারণে। হয়, সত্যি ডিকটেশান নিতে—তা আমি পারি না। নয়, অফিসের শোভাবর্ধন করতে,আমার ক্ষেত্রে সেটাও ঠিক নয়, কারণ আমার ফটো দেখেই পছন্দ করেছেন আপনি। এতদিনে তোমার মনের ভাব অবশ্য অন্য রকম হয়েছে, কিন্তু ফটো দেখেই নিশ্চয় গলে যাওনি তুমি। তৃতীয়ত, স্ত্রীর উপরোধ। কিন্তু মিসেস মুখার্জি আমাকে চেনেনই না যে সুপারিশ করবেন। আর স্টেনো রাখার চতুর্থ কারণ হতে পারে তাকে দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করানো। যেহেতু প্রথম তিনটি কারণ আমার ক্ষেত্রে অচল, তাই আমার ধারণা হয়েছিল, বিশ্বাসঘাতকতা করবার জন্যই আমাকে মাসে মাসে মাইনে দেওয়া হয়।
হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠে বলে–আচ্ছা, বুকে হাত দিয়ে বল তো অলক, আমার মাইনে বাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলে কেন? সে কি আমাকে ভালবেসে ফেলেছ বলেই, নাকি বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্যে?
অলক চিঙ্কার করে ওঠে-শাট আপ! ইউ ইনফার্নাল ভাইপার!
একগাল হেসে পর্ণা বলে–প্যারাডাইস লস্ট! মিল্টন!
থরথর করে কাঁপতে থাকে অলক, ভূকম্পনে উদগীরণ-উন্মুখ আগ্নেয়গিরির মতো। অথবা স্বর্গচ্যুত বিয়েলজিব্যাব-এর মতো।
পর্ণা একটু অপেক্ষা করে, আবার গম্ভীরভাবে বলতে থাকে—অলক, তোমার হাতে আছে অগাধ অর্থ, শ্রমিক-মালিকের যুদ্ধে তুমি অন্যায়ভাবে প্রয়োগ করছ তোমার ক্ষমতা। ফ্যাক্টরীতে লক-আউট ঘোষণা করে, ছাঁটাই করে, ধৰ্মঘাটি কর্মীদের পাওনা না দিয়ে তুমি আর্থিক পীড়ন করে চলেছ-অন্যায়-যুদ্ধ চালাচ্ছ তোমার তরফ থেকে। সুতরাং এ-পক্ষ অন্যায়-যুদ্ধ করলে রাগ করছ কেন? আর তা ছাড়া জান তো, জীবনের দুটি ক্ষেত্রে অন্যায় বলে কোনো শব্দের স্বীকৃতি নেই! এ বিষয়ে আমি চমৎকার একটা কোটেশান শুনেছিলাম ছাত্ৰীজীবনে। সেটা আজও ভুলিনি আমি দেয়ার্স নাথিং আনফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়্যার! বলতে পার কার কোটেশান?
অলক জবাব দেয় না।
পর্ণা আমার দিকে ফিরে বলে–আপনি জানেন?
জবাব দেবার ক্ষমতা তখন আমারও ছিল না।
—এটা লাভ না ওয়্যার ঠিক জানি না, সম্ভবত দুটোই। সুতরাং এখানে অন্যায়-যুদ্ধ করায় আমার বিবেকে কোনো দাগ পড়েনি।
আবার সংযম হারায় অলক, বলে বিবেক! তোমার মতো রাস্তায়-পাওয়া নষ্ট মেয়ের বিবেক বলে আবার কিছু থাকে নাকি?
পর্ণা চমকে ওঠে। ঠিক এ ভাষায় গালাগালি শুনবার জন্য বোধকরি প্রস্তুত ছিল না সে। চাবুক সেই চালাচ্ছিল এতক্ষণ, ডাইনে-বাঁয়ে—কিন্তু শালীনতার সীমা অতিক্রম না করে, রুচির মাত্রা না ছাড়িয়ে। পর্ণার শ্বাপদ চোখ দুটি জ্বলে ওঠে।
অলক উত্তেজিতভাবে বলে–যাক, অনেক অর্থ তুমি নিয়েছ কোম্পানির, এখন বল—কত টাকা পেলে এই যুদ্ধ থেকে তুমি সরে দাঁড়াতে পার?
আমি তখন সম্পূর্ণ অসাড় হয়ে গেছি। নীচে, কত নীচে নেমে গেছে ঐ মেয়েটা! একদিন একই ক্লাসে পড়তাম আমরা, বসতাম একই বেঞ্চিতে। আমার অন্তরাত্মা বলে উঠল–বল পর্ণা, এখানে অন্তত একবার বল—টাকা দিয়ে আদর্শকে কেনা যায় না।
হায়রে আমার দুরাশা। অম্লানবদনে পর্ণা বলল–পাঁচ হাজার টাকা।
পকেট থেকে চেকবই বার করে অলক।
–মাফ করবেন, মুখার্জি-সাহেব। চেক নেব না, বাউন্স করতে পারে। ক্যাশ টাকা চাই!
এতক্ষণে আত্মসংবরণ করেছি আমি। প্রাণপণ শক্তিতে নিজেকে সংযত করে বলি—টাকা পেলে আপনারা বুঝি সব পারেন?
পর্ণা হেসে বলল–আপনি বুঝি বায়রন পড়েননি? অলকের একটা ফেভারিট কোটেশান শোনেননি?—রেডি মানি ইজ আলাদীনস ল্যাম্প?
ততক্ষণে আয়রন চেস্ট খুলে পাঁচ তাড়া নোট বার করে এনেছে অলক। পাঁচ বান্ডিল নোট টেবিলের ওপর রেখে বলে-এগুলো নেবার পরেও যে তুমি ব্ল্যাকমেলিং করবে না তার প্রমাণ কী?
–তাই কি পারি?
–পার, সব পার তুমি! তোমার মত চরিত্রহীন নষ্ট মেয়েমানুষ না পারে কী?
আমার ভীষণ কান্না পায়। ছি ছি ছি। মাত্র পাঁচটা হাজার টাকার শোকে অলক এমন অভিভূত হয়ে পড়ল? শালীনতাবোধ বলে কি কিছুই অবশিষ্ট নেই তার। কিন্তু এ টাকার শোকে নয়–অপমানের জ্বালায়। স্ত্রীর সামনে তার চরিত্রের প্রতি ইঙ্গিত করায় ভদ্রতাবোধ হারিয়ে ফেলেছে অলক!
পর্ণার চোখদুটি জ্বলে ওঠে। শাপদ চক্ষু! কয়েক মিনিট চুপ করে কী ভাবে, বোধহয় সামলে নেয় নিজেকে। তারপর অদ্ভুতভাবে হাসে ও বলে, একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না অলক?
ও গর্জে ওঠে—বাড়াবাড়ি! তোমার মতো বিশ্বাসঘাতক নষ্ট চরিত্রের মেয়ে—
হাত তুলে তাকে থামিয়ে দেয় পর্ণা। বলে–বিশ্বাসঘাতকতা তুমি কাকে বল অলক? বিশ্বাসঘাতক কে নয়? আমার সঙ্গে রাত বারোটায় ফল অফ বার্লিন দেখে এসে যখন স্ত্রীর কাছে পোলিশ বন্ধুর গল্প বলেছিলে তখন ও শব্দটার মানে তুমি জানতে? শুধু তাই নয়–আবার হেসে হেসে সে গল্প যখন আমার কাছে ফলাও করে বলেছিলে তখনও কি মনে ছিল, আমি রাস্তায়-পাওয়া নষ্ট মেয়েমানুষ?
অলক জবাব দিতে পারে না। বাকরোধ হয়ে গিয়েছে যেন তার। পর্ণা হেসে বলে-ভয় নেই; ব্ল্যাকমেলিং আমি করতে পারব না। যতই কেন না নষ্ট চরিত্রহীন হই। তোমার মৃত্যুবাণ যেমন রইল আমার হাতে, তেমনি আমার মৃত্যুবাণও যে রয়ে গেল তোমার কাছে। নিজ নিজ স্বার্থে আমরা পরস্পরকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারব না। বাঙালি গৃহস্থঘরের বধূ আমি, বিখ্যাত শ্রমিক নেতার স্ত্রী বলে শ্ৰমিকমহলে সবাই আমাকে চেনে–তা ছাড়া তোমার-আমার অন্তরালের জীবনকথা যেমন সুনন্দা দেবী জানেন না, তেমনি গৌতমও তো জানে না। সব কথা কি মুখ ফুটে তাকেই বলতে পেরেছি ছাই? সুতরাং আমার যে চিঠিগুলি তোমার কাছে রয়ে গেল, সেলফ-এক্সপোজারে ভোলা আমাদের সেই আলিঙ্গনবদ্ধ ফটো…আর তা ছাড়া হোটেলের রেজিস্টার খাতায় আমাদের সই—সেই যে হোটেলে আমরা দুজনে সারারাত…